সাহিত্য নয়নে আপনাকে স্বাগত
মঙ্গলবার, ২৯ মার্চ, ২০২২
সম্পাদকীয়
প্রকৃতি কথা বলে, কথা শোনেও, কিন্তু কখনো বেইমানি করে না। ঠিক সময়েই হাজির হয় ভিন্ন ভিন্ন রূপে। আজও সেজেছে অপরূপ সাজে। গাছে গাছে কত রাঙা শিমুল, কত পলাশ, চারিদিক মুখরিত কোকিলের কুহু কুহু গানে। কৃষ্ণচূড়া যেন অঞ্জলি দিতে প্রস্তুত। ঋতুরাজ বসন্ত যেন প্রকৃতির মুখ দিয়েই জানান দিচ্ছে তার আগমন বার্তা। আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হচ্ছে কবিগুরুর সুরে---"ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল লাগলো যে দোল"। বসন্তের আগমনে প্রকৃতির সাথে তাল মিলিয়ে শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের মনও হয়ে উঠে রঙিন। মনে দোল খায় এক সুন্দর অনুভূতি। স্বপ্নের রংমহলে এবছর তৃপ্ত হব প্রিয়জনদের রঙিন ভালোবাসায়।
প্রিয় পাঠক, আপনাদের ভালোবাসা এবং প্রেরণাকে সাথী করে সাফল্যের যাত্রাপথে আমরা আরো এক ধাপ এগিয়ে গেলাম। এবারে প্রকাশিত হলো "সাহিত্য নয়ন"-এর "বসন্ত উৎসব সংখ্যা ২" নামক ১৯তম সংখ্যা। সম্মানিত কবিদের লেখনীতে যেন লেগেছে বসন্তের ছোঁয়া। স্বকীয়তা, মাধুর্য, গভীরতা সবকিছু মিলিয়ে নয়নের পাতাকে কবি-লেখনী দিয়ে সাজিয়েছেন অপরূপ সাজে। চলুন আমরা সবাই মিলে উনাদের সাজানো পাতা থেকে রস আস্বাদন করি। আপনাদের সার্বিক মতামতের অপেক্ষায় রইলাম। আবারো দেখা হবে আগামী বাংলা নববর্ষের কোনো একদিনে।
ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা সহ----
রাজেশ ভট্টাচার্য্য
সম্পাদক, "সাহিত্য নয়ন"
অমল কুমার মাজি
আজ বসন্ত
-----অমল কুমার মাজি
ফুলকুঁড়িরা উঠল জেগে
দখিন বাতাস গাইল গান
শিমূল-পলাশ উঠল জেগে
দোয়েল-কোকিল ধ'রল তান।।
মৌমাছিরা ফুলের কানে
গোপন কথা ব'লল তাই
আশাবরীর কোমল স্বরে
উঠল বেজে তার -সানাই।।
সাজল ফাগুন আগুন রঙে
উঠল দুলে প্রেমিক-মন
আজ বসন্ত,তাই মাধবীর
গন্ধে মাতাল কুঞ্জবন।।
আজ মধুমাস,বাজল যে তাই
প্রেম-সোহাগের মধুর বীণ
সব কিছু তাই অন্য রকম
ভালোবাসার নতুন দিন।।
হেমন্ত দেবনাথ
পথ
-----হেমন্ত দেবনাথ
পথ তুমি কার?
তুমি তো সবার।
তোমার উপর আনাগোনা
যাত্রী আর যানবাহন,
সংখ্যা নাহি যায় গুণা।
তোমার বুকে সহসা
যতসব "যানজট।"
সেই 'জ্যাম' খোলে না চটপট।
তোমার কালো পীচের উপর
স্বাচ্ছন্দ্যে যাতায়াতে ----
সবারই যেন নজর।
তুমি নীরব স্বাক্ষী,
দেখেছো কত না দুর্ঘটনা---
এ নিয়ে তোমার বুকে নির্বাক যাতনা।
মাঝে মাঝে তুমি হাঁফিয়ে পড়ো।
তবুও তুমি দায়িত্ব পালিতে দৃঢ়।
অবিরত যানবাহনের চাপে
তোমার যেন নাভিঃশ্বাস।
বুঝতে চায় না কেউ তোমার দীর্ঘশ্বাস।
সবাই তোমায় ব্যবহার করি
স্বার্থপরের মতো।
বর্জ্য-আবর্জনা তোমার উপর
ফেলে দেয় যত।
তোমার শরীরের ক্ষত সারাতে
বেমালুম যায় ভুলে।
সারিয়ে তোমার দায়িত্ব পিঠে----
সহসা নিতে চায়নি তুলে।
পথ,তুমি সর্বক্ষণের সাথী।
ধন্য যাত্রীরা হৃদয়ে তোমায় গাঁথি।
কিশোর কুমার ভট্টাচার্য
করুয়া মন
-------কিশোর কুমার ভট্টাচার্য
আজমতের আজ হয়েছে
বড়ো খিদমত ;
বেজায় আছে চটে
একটা ঘটনাও আছে বটে।
কেউ জানুক বা
না জানুক,
জানে একজনা
সকাল থেকে সন্ধ্যা গড়ালো
একবারও খবর নিলো না।
সামনে এলেই জানার ভান
কেমন আছেন আজমত খান!
আজ কাজের ভারে সামনা-সামনি কথা হয়নি
তা-ই বলে কী হয়ে গেলো
দূরের মেহমান।
রাগে গোঁসায় ফুঁসছে আলি
টের পাবিরে বাগান মালি ;
খামখেয়ালি মেজাজ করে
হোস না যেনো চোখের বালি।
রচনাকাল :-১৭/৩/২০২২ইং
সুজন দেবনাথ
শুধু তোমায় রাঙাবে বলে
-------সুজন দেবনাথ
ওগো আমার প্রাণের সখা
আঁখি খুলে তুমি দেখো,
নবীন আজি ডাকছে তোমায়
তারে তব হৃদয়ে রেখো।
প্রভাতের এই মুক্ত হাওয়ায়
পুলকিত হোউক প্রাণ,
প্রতিটা সকাল উজ্জ্বল হয়ে
ধরা দিক তব স্থান।
উজ্জ্বল হোক আগামী তোমার
এই নবীন প্রাতের মতো,
প্রতিটা বসন্ত তোমারই হয়ে
ফুল ফুটুক শতো শতো।
যেমন কাটে আঁধার যামিনী
শশী চন্দ্রিমা দিয়ে ধরা,
তোমারও আঁধার কাটবে বন্ধু
হইওনা কো দিসে হারা।
চেয়ে দেখো আজো কতো কুঁড়ি
ওই পলাশের ডালে ডালে,
কোকিল আজো গায়নি সে গান
শুধু তোমায় রাঙাবে বলে।
শান্তশ্রী মজুমদার
বসন্তে সোজা পথ
------শান্তশ্রী মজুমদার
বাঁকা পথ, সোজা পথ। পথ চলেছে পথের টানে। পথ চলেছে পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে গহন সবুজ বনের ছায়া ছায়া পথে। পথ চলেছে গভীর খাদের গা ছুঁয়ে। পিচ ঢালা মসৃন পথের সাথী হয়ে দেবস্থল আর বেলকম পাহাড় চলেছে অনাদিকাল ধরে কৈলাসহর থেকে ধর্মনগরের পথের সাথী হয়ে। বাঁকা পথে বৃদ্ধ বৃক্ষদের শীতল সুনিবিড় ছায়াময় পথে চলে যেতাম পাহাড়ের গা ঘেঁষে। শীত শেষে বসন্তের শুষ্ক হাওয়ায় পাহাড়ের পথে চলতো ঝরাপাতার উদাসী বৈরাগ্য।
আলোছায়ার খেলায় ঊনকোটি র মহাদেবকে প্রণাম করে ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে, বাঁকা পথটি পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে গহন সবুজ বনের ছায়া ছায়া পথে এগিয়ে যেতো ডানে বামে দোল খাওয়াতে খাওয়াতে।হঠাত্ করে পাহাড়ি রাস্তা শেষ হয়ে যেতো আনন্দ বাজারে।আনন্দবাজারের পথ পৌঁছে যেতো নয়নাভিরাম হাফলংছড়া চা বাগানের পশ্চিম ঘেঁষে।
শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, বসন্ত প্রতিটি ঋতুতে পাহাড় প্রকৃতির ভিন্ন ভিন্ন রূপ মনকে স্নাত করতো হৃদয় ছোঁয়ার নেশায়।
বাঁকাপথে ধুলোর বসন্তে, ধুলোর আবির উড়ছে আকাশে বাতাসে। বাঁকা পথটি বেলকম টিলার বুকচিরে সোজা হচ্ছে।পাহাড়ের বুক বিদীর্ণ করে সভ্যতার পথ এগিয়ে চলেছে.....।
হাজারো শতাব্দীর সাক্ষী শ্যাওলা ধরা বৃক্ষগুলোর নিথর দেহ পড়ে আছে পথের ধুলোয়। শাল সেগুনের ঘন সবুজ বনে শুধু ধুলোর ঝড়। আকাশে বাতাসে ধুলো আর ধুলো। নিস্তব্ধ ধ্যানমগ্ন বৃদ্ধ পাহাড় সভ্যতার যন্ত্রে বিদীর্ণ হয়ে প্রতিনিয়ত সোজা হচ্ছে, পথ করে দিচ্ছে বুকের পাঁজর চিরে।
সোজা তাকে হতেই হবে, মাথা তাকে নত করতেই হবে, ধুলোময় ধরণীর মাটিতে মিশে যেতেই হবে।প্রাগৈতিহাসিক যুগের পথ ধরে বহু রাজা মহারাজারা হাতির পিঠে চড়ে বনের বাঘ,শেয়াল,বিষধর সাপের সাথে লড়াই করে পথ চলেছে বেলকম আর দেবস্থল পাহাড়ঘেরা পথে। ব্যাকট্রীয় সভ্যতার গল্প,কতো মুনি ঋষির গল্প,কতো রাজা,মহারাজার গল্প, পথ চলার সাক্ষী এই পাহাড়।পাহাড়ের পশ্চিম দিগন্তে সূর্য ডোবার শোভা, অস্তগামী সূর্যের লুকোচুরির খেলা সবই হারিয়ে গেলো সোজা পথের নেশায়।
কাঁটা পাহাড় থেকে ঝুলে থাকা মৃত বৃক্ষদের বুকফাটা আর্তনাদ প্রতিধ্বনিত হোতে থাকে আমার শুষ্ক হৃদয়ে।শৈশব থেকে যে পথে পথ চলা শুরু, জীবনের শেষ প্রান্তে এসে জাতীয় সড়কের সোজা পথে গতিশীল যানে হু হু করে পোঁছে যাবো বহু স্মৃতি কে রোমন্থন করতে করতে।
ধুলোর বসন্তে, ধুলোর আবিরে, ধুলোময় পৃথিবীতে
বসন্তদিনের গান গাইবো নতুন আশায়, নতুন স্বপ্নে, কমলা আবিরে ।
রচনাকাল:--- 23/03/2023
চিরশ্রী দেবনাথ
------চিরশ্রী দেবনাথ
রুক্ষ পর্বতগাত্রে সূর্যদেব তাহার প্রখরকিরণ উদার সন্ন্যাসীর ন্যায় ঢালিয়া দিতেছে। চারিদিকে বিস্তৃত ক্রান্তীয় পর্ণমোচী অরণ্য, সকল পত্ররাজি বসন্তের ক্ষুধার্ত হস্তে নিজেদের সমর্পণ করিয়া বিরহী যক্ষের মতো অপেক্ষমান, কখন তাহাদের কাণ্ডে পৃথিবীর সকল বাধা অতিক্রম করিয়া কচি সবুজ পত্র নব উৎসাহভরে উঁকিঝুঁকি দিবে ইহাই কামনা। শন শন করিয়া বাতাস বহিতেছে। চক্ষুকর্ণ মুদ্রিত করিয়া কেহ যদি প্রাণপনে এই শনশন শব্দ শ্রবণ করে, তাহা হইলে সে বুঝিবে ইহাকে প্রণয়তাড়িত দীর্ঘশ্বাস বলে। কন্টক ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাথর সমাকীর্ণ উঁচুনিচু পথ চলিয়া গেছে বহুদূর। পাল্কী লইয়া বেহারাগণ যাইতেছে ধীরে ধীরে। সম্মুখে একটি ক্ষীণ ঝর্ণার কুলু কুলু নাদ শোনা যাইতেছে। কোন এক অত্যাশ্চার্য কারণে দীর্ঘদিন বর্ষণ না পাইয়াও সে তাহার জলধারায় কৈশোরের যৌবন লালন করিতেছে। বোধ করি পর্বতগাত্রের সকল স্বেদ ধুইয়া দিতে ঝর্ণাটি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, এই তাহার নারীত্ব।
ত্রিপুর দেশের রাজার আমন্ত্রণে ব্রহ্মচাঁদ মলয়াদিত্যের এই বিপজ্জনক, হিংস্র পশু ও বিষাক্ত সর্প কবলিত বহির্বিশ্বের নিকট প্রায় অজ্ঞাত কিরাতভূমিতে আগমন। উপলক্ষ ভীষণ গুরুতর নহে। ভ্রমণ এবং কিছুদিন রাজ আতিথেয়তায় থাকিয়া সংস্কৃত শাস্ত্রাদি অধ্যয়ন, রাজকুমারদিগকে পাঠ দান, সেইসঙ্গে রাজপুরুষদের সঙ্গে বসিয়া বেদ উপনিষদ ইত্যাদি বিষয়ে চর্চা,পারস্পরিক মত বিনিময় ইত্যাদি।
তিনি শীতের প্রাক্কালে আসিয়াছেন। শীত সমাপ্ত হইয়া চলিয়া গেছে। এইক্ষণে ঋতুরাজ বসন্তকালের আগমণে প্রকৃতিতে পুষ্প সৌরভ প্রবাহিত হইতেছে। মলয়াদিত্যের বয়স বেশী নয়। নিষ্ঠাবান ব্রহ্মচারী এবং প্রকৃতিপ্রেমী। কাব্য ও সঙ্গীতে তাহার আগ্রহ রহিয়াছে। তিনি সংস্কৃতর সহিত ফার্সীও অধ্যয়ন করিয়াছেন। প্রকৃতির রূপ দেখিতে তাহার ভালো লাগে। তাই রাজধানী হইতে নিস্ক্রান্ত হইয়া এই ভ্রমণ পরিকল্পনা। তাঁবু খাটাইয়া বনাঞ্চলে দুই তিন রাত্রি থাকিতে চাহেন।
যে জায়গায় পৌঁছাইয়াছেন, তিনদিকে তিনখানা গিরিশিরা বিস্তৃত।
ত্রিকালদর্শী শিবের মতো তাহারা আপন আপন রহস্য বিস্তার করিয়া আহ্বান করিতেছে, বলিতেছে এখানেই গরল, এখানেই অমৃত।
বনজ অপরাহ্ন সমাগত। রৌদ্রের তেজ কমিয়া আসিতেছে। স্থানে স্থানে ধুলোরাশি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঝটিকা বাতাসের দ্বারা মাঝে মাঝে বৃত্তাকার ঘূর্ণনের সৃষ্টি করিয়া চারপাশের শুষ্ক পত্ররাজি নিজের মধ্যে টানিয়া নিতেছে, হয়তো তাহাতে কোন এক হোমাগ্নি জ্বলিয়া উঠিবে, শুষ্ক পত্ররাজি নিঃশব্দে ফিসফিস করিয়া বলিবে বসন্ত মানে দগ্ধ হওয়া তিলে তিলে।
পর্বতগাত্রগুলিতে অসংখ্য কদলী বৃক্ষ । এক প্রকার কষা গন্ধ হঠাৎ হঠাৎ বাতাসে ভাসিয়া আসে। ইহা ছাড়াও আম্র ও পনস বৃক্ষ রাজি তাহাদের আসন্ন ফলসম্ভবার কথা সগৌরবে জানান দিতেছে। কচি কচি পনস বৃক্ষ হইতে ঝুলিয়া রহিয়াছে। আম্র মুকুল গুলি কিয়ৎ ঝড়ে ঝরিয়া যাইবে, তথাপি মৃত্যু সম্ভাবনাকে বাতিল করিয়া তাহারা সান্ধ্য আয়োজনে বিকশিত হইয়াছে। দোল পূর্ণিমা গত হইয়াছে। ক্ষয়াটে জ্যোৎস্না কৃষ্ণবিহীন বৃন্দাবনের ন্যায় নিষ্ঠুর পাহাড়কে জড়াইয়া ধরিয়া দেহ হইতে গোধূলির রঙ মুছিবার আপ্রাণ চেষ্টা করিতেছে। মলয়াদিত্য যত দেখেন ততই অবাক হইয়া যান। তাহারা গুটিকতক মানুষ এই বিপুল পৃথিবীর ক্ষুদ্র একটি অংশে ঋতুরাজকে অনুভব করিতে আসিয়াছেন, ইহা অপেক্ষা বৃহৎ কোন ঘটনা এই মুহূর্তে পৃথিবীর বুকে কি আর ঘটিতেছে? চতুর্দিকে বিহঙ্গ কুজন। বৃক্ষে তাহাদের পত্রগৃহ। অদূরেই প্রায় জলবিহীন একটি জলাশয়, তাহাতে দুই খানা শামুকচী নিভৃতে বসিয়া আছে, জলাশয়ে পদ্ম ফুটিয়াছে, কর্দমাক্ত জলের নীচে পদ্মের কোমল ডগা বিস্তৃত রহিয়াছে, সেই মসৃণ গাত্রে লোভী সূর্য রশ্মি পড়িয়াছে জলের আয়না ভেদ করিয়া। একটি অনুচ্চ টিলার ওপর কিংশুক গাছ। পত্র নাই বলিলেই হয়, শুধু শত শত রক্তাভ কিংশুক ফুটিয়া আছে। কোনও একটি নিভৃত স্থান হইতে কোকিল ডাকিতেছে, তাহা অপেক্ষা অধিক বসন্তদূত
দুঃখকষ্টবিরহলালিত পৃথিবীর পড়ে আর কেহ নাই। সহসাই একটি ঘটনা ঘটিল। বনাঞ্চল যদিও এখন অনেকটাই রিক্ত তথাপি তাহার গভীরতার একটি হা হুতাশ আছে, অন্তরাল আছে। সেই অন্তরাল হইতে উঠিয়া আসিতেছে গুটিকতক বনবাসী পুরুষ ও রমণী। তাহারা শিকার করিয়াছে। বংশকাণ্ডের মধ্যে ধনেশ, ভৃঙ্গরাজ প্রভৃতি বৃহদাকায় কয়েকটি পাখি বাঁধা রহিয়াছে, ছোট ছোট খাঁচার মধ্যে টিয়া, মুনিয়া পক্ষীশাবকেরা। সেইসময় এইধরনের পক্ষী পার্বত্য দেশ হইতে বৃহৎ বঙ্গে চালান হইতো।
দলটির নেতৃত্ব দিতেছে একটি খর্বকায়, স্বাস্থ্যবতী পার্বতী রমণী। তাহার গ্রীবায় পাথরের মালা, চূড়া করিয়া বাঁধা কেশে গোঁজা সাদা আর নীলাভ পাখির পালক। মলয়াদিত্যের হৃদয় ব্যথিত। আহা, এই পক্ষীগুলা কোন্ অজানা ন়ৃশংস পৃথিবীতে তাহাদের উড্ডয়ন স্তব্ধ করিয়া নীল আকাশের দিকে তাকিয়া কি ভাবিবে কে জানে! তিনি বিচলিত হইয়া দলটির সামনে দাঁড়াইলেন। তাহারা পরস্পরের কাছে অবোধ্য। তথাপি পাল্কীর বেহারা গনের সাহায্যে তিনি তাহাদের বোঝাতে সমর্থ হইলেন, সমস্ত পক্ষী তিনি লইতে চান। অবশেষে সামান্য বাকবিতণ্ডার পর উপযুক্ত তাম্রমুদ্রা এবং তাহাদের সঙ্গে আনা চাউল ও কিছু ফলমূলের বিনিময়ে তাহারা পক্ষী দিতে স্বীকৃত হইল। তৎক্ষণাৎ মলয়াদিত্য আদেশ দিলেন সমস্ত পক্ষী যেন তাহারা বন্ধন খুলিয়া ছাড়িয়া দেয়। বেহারাগণ তাই করিল। আর সেই বিহঙ্গকুল হয়তো প্রথমে বিশ্বাস করিতে পারে নাই, বিশ্বাস হওয়া মাত্র তাহাদের আহত পঙ্খ ঝটপটাইয়া উঠিল। ফুলের রেনু আর গন্ধে মুখরিত বায়ুপ্রবাহকে হৃদয়ে ধারণ করিয়া, দিবাকরের বৈকালিক রাগে রঙীন হইয়া ওঠা বিশাল আকাশে একে একে পক্ষীরা উড়িয়া যাইতে লাগিল। একটি পর্বত ঢালে দাঁড়াইয়া সে দৃশ্য দেখিতেছিলেন মলয়াদিত্য, চক্ষু অশ্রুসিক্ত হইয়া উঠিয়াছে, তিনি অস্ফুট কণ্ঠে বলিতেছেন,
"দ্রুমাঃ সপুষ্পাঃ সলিলং সপদ্মং
স্ত্রিযঃ সকামাঃ পবনঃ সুগন্ধিঃ .
সুখাঃ প্রদোষা দিবসাশ্চ রম্যাঃ
সর্বং প্রিযে চারুতরং বসন্তে .. "
তাহার পাশে বনবাসী গন দাঁড়াইয়া আছে। এমন সময়ে একটি আশ্চর্য ঘটনা ঘটিল, সেই রমণী যাহাকে দেখিলে সর্বাপেক্ষা হিংস্র মনে হয়, সে তাহার পিঠে বাঁধিয়া রাখা বংশশলাকা নির্মিত ঝুড়ির ভেতর লতাপাতার তলা হইতে একটি বৃহদাকায় জীবিত পানকৌড়িকে বাহির করিয়া, ধীরে ধীরে নীচের জলাশয়ের কাছে গিয়া ছাড়িয়া দিলো, তাহার পর মলয়াদিত্যের চক্ষুতে চক্ষু রাখিল, সেই দৃকপাতে দিগন্তের আহ্বান ছিল না, কোনরূপ সম্মতিও ছিল না, যাহা ছিল তাহা হইল ব্রহ্মচারী আমারো হৃদয় আছে, শুধু বিরাট ক্ষুধার নিকট সবকিছু হারাইয়া যায়। কাল আবার তীরধনুক চালাইব, রক্ত মাখিব। এই বসন্তও থাকিবে কিন্তু তুমি থাকিবে না এই অরণ্যে...
সুব্রত রায়
মা
----- সুব্রত রায়
গ্রীষ্মকাল কেটে যায় কোনরকম। শীতে কষ্ট অনেক বেশি। শীতের রাতে ফুলমতির ঠিকানা রেলষ্টেশন।
ছোটলোকের মেয়ে ফুলমতি দারুণ সুন্দরী। তাছাড়া ঝাডুর জন্ম-বৃত্তান্ত সবার জানা। চারবছর আগের ঘটনা। তখন থেকেই ছেলে ঝাড়ুকে নিয়ে ফুলমতি রাতটা ষ্টেশনে কাটিয়ে দেয়। একটা বাড়তি অনুকম্পা পাওয়া যায়।
রাত দশটায় শেষ লোকেল ঢুকে।ঐ ট্রেনে শহর থেকে ফেরে ফুলমতি। ইদানিং কাজটা নিয়েছে। ওখানে রোজগার অনেক বেশি।
দাঁড়িয়ে থাকলেও ইঞ্জিন সারা রাত চালু থাকে।তা ছাড়া সারাদিনের ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলতে থাকে তপ্ত যন্ত্রশকট।ইঞ্জিনের প্রায় তলায় আশ্রয় নেয় মা আর ছেলে,যান্ত্রিক ওম শুষে নেয় দুটো রক্তমাংসের শরীর। পাথরের ধারালো প্রান্তগুলো পিঠে খোঁচা দেয়।জোরে টানলে ছেড়া কাঁথা আরও ছিঁড়ে যায় । মনে মনে হাসে ফুলমতি, ইঞ্জিনটা কি পুরুষ!
আজ শীত বড্ড বেশি।সন্ধ্যা থেকে ঝাড়ুর কাঁপন আর থামছে না। মায়ের অপেক্ষায় যেন শীত আরও তীব্র হতে থাকে।
একটা হট্টগোল।ঝিমুনি এসেছিল।
চেচাঁমেচিতে তন্দ্রা ছুটে যায় ঝাডুর।
ব্রিজ ভেঙে ট্রেন নাকি নীচে পড়ে গেছে। এটাই শেষ ট্রেন।মা ফেরার কথা ছিল। ঝাড়ুর ছোট্ট শরীর, কাঁপন বেড়ে গেছে প্রচণ্ড।
মধুমিতা ভট্টাচার্য
মধ্যবিত্ত
-----মধুমিতা ভট্টাচার্য
একটি গোবরে পোকা,ভো ভো করে উড়ে।
আবার মাটিতে পড়ে যায়,
আবার উড়ে,আবার পড়ে,
একসময় শান্ত হয়ে মাটিতেই পড়ে থাকে।
ঠিক যেনো মধ্যবিত্তের মতো।
দু' নৌকায় পা দিয়ে চলতে চলতে,একসময় ভরাডুবি ঘটে।
সমাজ বিলাসের হাই স্ট্যাটাসে নাম লিখাতে ব্যস্ত বাইরে-
ঘরে তখনও
মাসকাবারি হিসেব নিয়ে তুমুল ঝগড়া বউয়ের সাথে -
" অমুক বাবুর ছেলে বিদেশ গেছে পড়তে,
মেয়ে বিয়েতেও কোটি টাকার বাজেট,
স্ট্যাটাস নিয়ে কথা !
ছেলেকে ডোনেশনে পড়াতে হবে বিদেশে।
দেশের পড়ার মুখে ছাই,
আর লোনে হবে মেয়ের বিয়ে,, ঠিক অমুক বাবুর মেয়েরই মতো।
পরে খাবো কি?আঙুল চুষবো?
এখন তা ভাববার সময় নেই।"
বছর খানেক পরে যখন
চাকরিতে রিটায়ার্ড,
কিছু গেল ছেলেকে বসাতে
কিছু গেল লোনে।
এবার,বাবুর আর সেই ঠাঁট নেই,বাট আছে ঝুলে।
পুরনো কাপড়ে ইস্ত্রি দিয়ে
রেশনে মুখ ঢেকে।
"রেগার খাতায় নাম লেখাতে
পারবো না তো কভু?"
পকেট খালি হলেও
মধ্যবিত্তের স্ট্যাটাস ভারি।
বড়লোকের নাইট পার্টিতে
ইনভাইটেশন আসেনা তবু !
এ দলের নয়,ও দলের নয়
মাঝখানে হাবুডুবু।
রাজেশ ভট্টাচার্য্য
হোক লুকোচুরির অবসান
----- রাজেশ ভট্টাচার্য্য
আঁকা-বাঁকা পাহাড়ী পথে
আমাদের প্রথম যোগ।
পথে ছিলনা কোনো কালো ছাপ।
দেখেছি সেই পথ
তোমার চোখে, তোমার কবিতায়।
ভাঙা পথেই প্রথম পেয়েছি তোমাকে,
তোমার সৃষ্টিতে, তোমার কারিগর কবিতায়।
চার চোখ কথা বলেনি আজও।
তবু করেছো, আপনার চেয়েও আপনার।
হে কিশোর কবি!
চলো যাই হেমন্তের কাছে।
হোক লুকোচুরির অবসান।