------চিরশ্রী দেবনাথ
রুক্ষ পর্বতগাত্রে সূর্যদেব তাহার প্রখরকিরণ উদার সন্ন্যাসীর ন্যায় ঢালিয়া দিতেছে। চারিদিকে বিস্তৃত ক্রান্তীয় পর্ণমোচী অরণ্য, সকল পত্ররাজি বসন্তের ক্ষুধার্ত হস্তে নিজেদের সমর্পণ করিয়া বিরহী যক্ষের মতো অপেক্ষমান, কখন তাহাদের কাণ্ডে পৃথিবীর সকল বাধা অতিক্রম করিয়া কচি সবুজ পত্র নব উৎসাহভরে উঁকিঝুঁকি দিবে ইহাই কামনা। শন শন করিয়া বাতাস বহিতেছে। চক্ষুকর্ণ মুদ্রিত করিয়া কেহ যদি প্রাণপনে এই শনশন শব্দ শ্রবণ করে, তাহা হইলে সে বুঝিবে ইহাকে প্রণয়তাড়িত দীর্ঘশ্বাস বলে। কন্টক ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাথর সমাকীর্ণ উঁচুনিচু পথ চলিয়া গেছে বহুদূর। পাল্কী লইয়া বেহারাগণ যাইতেছে ধীরে ধীরে। সম্মুখে একটি ক্ষীণ ঝর্ণার কুলু কুলু নাদ শোনা যাইতেছে। কোন এক অত্যাশ্চার্য কারণে দীর্ঘদিন বর্ষণ না পাইয়াও সে তাহার জলধারায় কৈশোরের যৌবন লালন করিতেছে। বোধ করি পর্বতগাত্রের সকল স্বেদ ধুইয়া দিতে ঝর্ণাটি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, এই তাহার নারীত্ব।
ত্রিপুর দেশের রাজার আমন্ত্রণে ব্রহ্মচাঁদ মলয়াদিত্যের এই বিপজ্জনক, হিংস্র পশু ও বিষাক্ত সর্প কবলিত বহির্বিশ্বের নিকট প্রায় অজ্ঞাত কিরাতভূমিতে আগমন। উপলক্ষ ভীষণ গুরুতর নহে। ভ্রমণ এবং কিছুদিন রাজ আতিথেয়তায় থাকিয়া সংস্কৃত শাস্ত্রাদি অধ্যয়ন, রাজকুমারদিগকে পাঠ দান, সেইসঙ্গে রাজপুরুষদের সঙ্গে বসিয়া বেদ উপনিষদ ইত্যাদি বিষয়ে চর্চা,পারস্পরিক মত বিনিময় ইত্যাদি।
তিনি শীতের প্রাক্কালে আসিয়াছেন। শীত সমাপ্ত হইয়া চলিয়া গেছে। এইক্ষণে ঋতুরাজ বসন্তকালের আগমণে প্রকৃতিতে পুষ্প সৌরভ প্রবাহিত হইতেছে। মলয়াদিত্যের বয়স বেশী নয়। নিষ্ঠাবান ব্রহ্মচারী এবং প্রকৃতিপ্রেমী। কাব্য ও সঙ্গীতে তাহার আগ্রহ রহিয়াছে। তিনি সংস্কৃতর সহিত ফার্সীও অধ্যয়ন করিয়াছেন। প্রকৃতির রূপ দেখিতে তাহার ভালো লাগে। তাই রাজধানী হইতে নিস্ক্রান্ত হইয়া এই ভ্রমণ পরিকল্পনা। তাঁবু খাটাইয়া বনাঞ্চলে দুই তিন রাত্রি থাকিতে চাহেন।
যে জায়গায় পৌঁছাইয়াছেন, তিনদিকে তিনখানা গিরিশিরা বিস্তৃত।
ত্রিকালদর্শী শিবের মতো তাহারা আপন আপন রহস্য বিস্তার করিয়া আহ্বান করিতেছে, বলিতেছে এখানেই গরল, এখানেই অমৃত।
বনজ অপরাহ্ন সমাগত। রৌদ্রের তেজ কমিয়া আসিতেছে। স্থানে স্থানে ধুলোরাশি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঝটিকা বাতাসের দ্বারা মাঝে মাঝে বৃত্তাকার ঘূর্ণনের সৃষ্টি করিয়া চারপাশের শুষ্ক পত্ররাজি নিজের মধ্যে টানিয়া নিতেছে, হয়তো তাহাতে কোন এক হোমাগ্নি জ্বলিয়া উঠিবে, শুষ্ক পত্ররাজি নিঃশব্দে ফিসফিস করিয়া বলিবে বসন্ত মানে দগ্ধ হওয়া তিলে তিলে।
পর্বতগাত্রগুলিতে অসংখ্য কদলী বৃক্ষ । এক প্রকার কষা গন্ধ হঠাৎ হঠাৎ বাতাসে ভাসিয়া আসে। ইহা ছাড়াও আম্র ও পনস বৃক্ষ রাজি তাহাদের আসন্ন ফলসম্ভবার কথা সগৌরবে জানান দিতেছে। কচি কচি পনস বৃক্ষ হইতে ঝুলিয়া রহিয়াছে। আম্র মুকুল গুলি কিয়ৎ ঝড়ে ঝরিয়া যাইবে, তথাপি মৃত্যু সম্ভাবনাকে বাতিল করিয়া তাহারা সান্ধ্য আয়োজনে বিকশিত হইয়াছে। দোল পূর্ণিমা গত হইয়াছে। ক্ষয়াটে জ্যোৎস্না কৃষ্ণবিহীন বৃন্দাবনের ন্যায় নিষ্ঠুর পাহাড়কে জড়াইয়া ধরিয়া দেহ হইতে গোধূলির রঙ মুছিবার আপ্রাণ চেষ্টা করিতেছে। মলয়াদিত্য যত দেখেন ততই অবাক হইয়া যান। তাহারা গুটিকতক মানুষ এই বিপুল পৃথিবীর ক্ষুদ্র একটি অংশে ঋতুরাজকে অনুভব করিতে আসিয়াছেন, ইহা অপেক্ষা বৃহৎ কোন ঘটনা এই মুহূর্তে পৃথিবীর বুকে কি আর ঘটিতেছে? চতুর্দিকে বিহঙ্গ কুজন। বৃক্ষে তাহাদের পত্রগৃহ। অদূরেই প্রায় জলবিহীন একটি জলাশয়, তাহাতে দুই খানা শামুকচী নিভৃতে বসিয়া আছে, জলাশয়ে পদ্ম ফুটিয়াছে, কর্দমাক্ত জলের নীচে পদ্মের কোমল ডগা বিস্তৃত রহিয়াছে, সেই মসৃণ গাত্রে লোভী সূর্য রশ্মি পড়িয়াছে জলের আয়না ভেদ করিয়া। একটি অনুচ্চ টিলার ওপর কিংশুক গাছ। পত্র নাই বলিলেই হয়, শুধু শত শত রক্তাভ কিংশুক ফুটিয়া আছে। কোনও একটি নিভৃত স্থান হইতে কোকিল ডাকিতেছে, তাহা অপেক্ষা অধিক বসন্তদূত
দুঃখকষ্টবিরহলালিত পৃথিবীর পড়ে আর কেহ নাই। সহসাই একটি ঘটনা ঘটিল। বনাঞ্চল যদিও এখন অনেকটাই রিক্ত তথাপি তাহার গভীরতার একটি হা হুতাশ আছে, অন্তরাল আছে। সেই অন্তরাল হইতে উঠিয়া আসিতেছে গুটিকতক বনবাসী পুরুষ ও রমণী। তাহারা শিকার করিয়াছে। বংশকাণ্ডের মধ্যে ধনেশ, ভৃঙ্গরাজ প্রভৃতি বৃহদাকায় কয়েকটি পাখি বাঁধা রহিয়াছে, ছোট ছোট খাঁচার মধ্যে টিয়া, মুনিয়া পক্ষীশাবকেরা। সেইসময় এইধরনের পক্ষী পার্বত্য দেশ হইতে বৃহৎ বঙ্গে চালান হইতো।
দলটির নেতৃত্ব দিতেছে একটি খর্বকায়, স্বাস্থ্যবতী পার্বতী রমণী। তাহার গ্রীবায় পাথরের মালা, চূড়া করিয়া বাঁধা কেশে গোঁজা সাদা আর নীলাভ পাখির পালক। মলয়াদিত্যের হৃদয় ব্যথিত। আহা, এই পক্ষীগুলা কোন্ অজানা ন়ৃশংস পৃথিবীতে তাহাদের উড্ডয়ন স্তব্ধ করিয়া নীল আকাশের দিকে তাকিয়া কি ভাবিবে কে জানে! তিনি বিচলিত হইয়া দলটির সামনে দাঁড়াইলেন। তাহারা পরস্পরের কাছে অবোধ্য। তথাপি পাল্কীর বেহারা গনের সাহায্যে তিনি তাহাদের বোঝাতে সমর্থ হইলেন, সমস্ত পক্ষী তিনি লইতে চান। অবশেষে সামান্য বাকবিতণ্ডার পর উপযুক্ত তাম্রমুদ্রা এবং তাহাদের সঙ্গে আনা চাউল ও কিছু ফলমূলের বিনিময়ে তাহারা পক্ষী দিতে স্বীকৃত হইল। তৎক্ষণাৎ মলয়াদিত্য আদেশ দিলেন সমস্ত পক্ষী যেন তাহারা বন্ধন খুলিয়া ছাড়িয়া দেয়। বেহারাগণ তাই করিল। আর সেই বিহঙ্গকুল হয়তো প্রথমে বিশ্বাস করিতে পারে নাই, বিশ্বাস হওয়া মাত্র তাহাদের আহত পঙ্খ ঝটপটাইয়া উঠিল। ফুলের রেনু আর গন্ধে মুখরিত বায়ুপ্রবাহকে হৃদয়ে ধারণ করিয়া, দিবাকরের বৈকালিক রাগে রঙীন হইয়া ওঠা বিশাল আকাশে একে একে পক্ষীরা উড়িয়া যাইতে লাগিল। একটি পর্বত ঢালে দাঁড়াইয়া সে দৃশ্য দেখিতেছিলেন মলয়াদিত্য, চক্ষু অশ্রুসিক্ত হইয়া উঠিয়াছে, তিনি অস্ফুট কণ্ঠে বলিতেছেন,
"দ্রুমাঃ সপুষ্পাঃ সলিলং সপদ্মং
স্ত্রিযঃ সকামাঃ পবনঃ সুগন্ধিঃ .
সুখাঃ প্রদোষা দিবসাশ্চ রম্যাঃ
সর্বং প্রিযে চারুতরং বসন্তে .. "
তাহার পাশে বনবাসী গন দাঁড়াইয়া আছে। এমন সময়ে একটি আশ্চর্য ঘটনা ঘটিল, সেই রমণী যাহাকে দেখিলে সর্বাপেক্ষা হিংস্র মনে হয়, সে তাহার পিঠে বাঁধিয়া রাখা বংশশলাকা নির্মিত ঝুড়ির ভেতর লতাপাতার তলা হইতে একটি বৃহদাকায় জীবিত পানকৌড়িকে বাহির করিয়া, ধীরে ধীরে নীচের জলাশয়ের কাছে গিয়া ছাড়িয়া দিলো, তাহার পর মলয়াদিত্যের চক্ষুতে চক্ষু রাখিল, সেই দৃকপাতে দিগন্তের আহ্বান ছিল না, কোনরূপ সম্মতিও ছিল না, যাহা ছিল তাহা হইল ব্রহ্মচারী আমারো হৃদয় আছে, শুধু বিরাট ক্ষুধার নিকট সবকিছু হারাইয়া যায়। কাল আবার তীরধনুক চালাইব, রক্ত মাখিব। এই বসন্তও থাকিবে কিন্তু তুমি থাকিবে না এই অরণ্যে...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন