সাহিত্য নয়নে আপনাকে স্বাগত

"সাহিত্য নয়ন" সাহিত্য পত্রিকায় আপনাকে স্বাগত। ( প্রকাশকের লিখিত অনুমতি ছাড়া এই পত্রিকার কোন অংশ কেউ প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে)

শনিবার, ১৫ এপ্রিল, ২০২৩

সুব্রত রায়


                                                                       সমীক্ষা


                                                                                 ---- সুব্রত রায়


    সেটা ছিল আরেক বসন্ত-বিকেল। এখানে ওখানে সবুজ রঙ করা কয়েকটা কাঠের বেঞ্চ। দশতলার উপর ষ্টিলের ফ্রেমে আটকানো 'মরমী হাউজিং কমপ্লেক্স' লেখাটা দিনের বেলা দেখা যায় না। তবে রাত হলে গ্লো সাইন জ্বলজ্বল করে বহুদূর থেকে। 

   চারপাশে সুউচ্চ সার দেওয়া অসংখ্য ফ্ল্যাট-বাড়ি। সব মিলিয়ে কত লোক থাকে অতনুবাবু জানেন না। কমপ্লেক্সের সামনের দিকে খোলা এই পার্কটা ভাল লেগেছিল সবচেয়ে বেশি। চাকরির শেষ বছর বুক করেছিলেন। কোয়ার্টার ছেড়ে সোজা মরমীতে।

  সময় ভালই কেটে যায় এখন। সবমিলিয়ে বুড়োদের সংখ্যাটা একেবারে কম নয়। গল্পগুজবে কী করে সন্ধ্যা নামে বুঝা যায় না। সূর্য ডুবতে না ডুবতে ফা ফা করে খুটির মাথায় জ্বলে উঠে সারি সারি সোডিয়াম ভ্যাপার ল্যাম্প। সন্ধ্যা আর রাতের মিশে যাওয়াটা আর দেখা হয় না। আকাশ তারাহীন, কেমন ঘোলাটে একটা আস্তরণ ঝুলে আছে মনে হয়।

   এসব আপাত অপ্রাপ্তিকে ভুলে যাওয়াই ভাল। নিজেদের অতীত  জীবনের হাজারো গল্পে নিজেকে  উজ্জীবিত করে রাখা বরং বুদ্ধিমানের কাজ। রক্তচাপ আর ব্লাড সুগারের রিপোর্ট পরীক্ষা করতে করতে ডাক্তাররা আজকাল নষ্টালজিক হতে বারণ করেন।

  এসব ভাবনার ফাঁকে কখন যে শ্রীমন্তবাবু এসে গেছেন, খেয়াল ছিল না।

 -আরে মেজর, অমন ঝিম মেরে আছেন কেন? আমি আসতে আসতে একটু হেঁটে নিলেই তো পারতেন। অতনুবাবু ইন্ডিয়ান আর্মিতে ছিলেন। শ্রীমন্তবাবু মজা না করে কোনো কথা বলেন না। প্রাক্তন  কলেজ শিক্ষক শ্রীমন্তবাবুকে এজন্যেই বড্ড ভাল লাগে।

-আর কত হাঁটবো বলুন? ফ্ল্যাট থেকে এখানে পৌঁছতে পাক্কা আধা ঘন্টা। এখন বসতেই ভাল লাগছে। বসুন এখানে। বলুন, আজকে যেন কী শুনাবেন বলেছিলেন।

-হ্যাঁ হ্যাঁ। টেনশন একদম করবেন না। এই ধরুন, একটা পান মুখে দিন। বলছি। বাংলার প্রফেসর শ্রীমন্তবাবু দারুণ গল্প বলতে পারেন। কল্পনা আর বাস্তবতার অদ্ভুত মিশেল তার বলায়। তবে শেষ দিকে একটা ভয়ংকর অনিশ্চয়তায় শেষ হয় সে গল্প। শ্রোতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিতে দারুণ আমুদ পান তিনি।

   নিজের মুখের গোটা খিলি গালে চালান করে দিয়ে গল্প শুরু করেন শ্রীমন্ত বাবু।

   তখন আমরা কলেজে পড়ি। বাংলা বিভাগের ছাত্র। যৌবনে কোন বাঙালি কবিতা না লিখে থাকে। ঠিক হ'ল কবিতা লিখতে হবে, তবে গতানুগতিক মোটেও না। প্রথমে ফিল্ড সার্ভে হবে। নানা পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলার পর কবিতা লেখা হবে। সাক্ষাৎকারের অভিজ্ঞতা হবে কবিতার মূল বিষয়।

   তা, খাতা কলম নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম একদিন। গ্রাম থেকে আধা শহর, বাদ গেল না কিছুই। দেখলাম, কৃষক ধান কাটছে। তাকে বললাম, "কিছু বলুন, একটা কবিতা লিখতে চাই।"  সে কোনো উত্তরই দিল না। মুচকি হেসে ধান কাটতে লাগলো ঘ্যাজঘ্যাজ করে।

  এরপর একজন কর্মকার। একই অনুরোধ তার কাছেও করা হ'ল। "দাদা, একটু বলবেন, এ্যাই একটা কবিতা লিখবো আর 

কী।" তিনি জ্বলন্ত চুল্লী থকে ডগডগে লাল লোহার টুকরো বের করে এনে দুমদাম পেটাতে লাগলেন একমনে। উত্তর কিছুই পাওয়া গেল না। এরপর, রজক, ক্ষৌরকর্মি, মৃৎশিল্পী এদের কাছেও যাওয়া হল। ফলাফল এক, সবাই নিজের কাজে মহাব্যস্ত, উত্তর নেই।

    সে যা-ই হোক। কবিতা তো লিখতেই হবে। লেখাও হয়ে  গেল। শর্ত ছিল যাদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে কবিতা লেখা হবে, সেই কবিতা তাদেরকেই শোনাতে হবে। জানতে হবে তাদের প্রতিক্রিয়া। অনেক সাধ্যসাধনার পর অবশ্য আনা গিয়েছিল তাদের। ওঁদের বসানো হ'ল। চা মিষ্টিরও ব্যবস্থা ছিল। তা, গালে হাত দিয়ে মনযোগ সহ শুনলোও ওঁরা আমার লেখা কবিতা। 

   সবশেষে প্রতিক্রিয়ার পালা। -আচ্ছা বলুন তো, কবিতাটা শুনে কী বুঝলেন আপনারা? কিছুক্ষণ একদম চুপচাপ। আবারও অনুরোধ করা গেল। ওঁরা প্রথমে  পরস্পর এ ওর মুখের দিকে তাকায়, কিচ্ছু বলে না। অনেক পীড়াপীড়ির পর শেষমেশ, সেলুনের সেই লোকটা উঠে দাঁড়ালেন। - বাবু, একটা কথা, কবিতাটার গভ্ভে মস্ত বড় বড় সব কথা বলা হয়েছে, এ বিষয়ে আমরা একমত। তবে আমরা কেউ কিছুই বুঝিনি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন