সাহিত্য নয়নে আপনাকে স্বাগত

"সাহিত্য নয়ন" সাহিত্য পত্রিকায় আপনাকে স্বাগত। ( প্রকাশকের লিখিত অনুমতি ছাড়া এই পত্রিকার কোন অংশ কেউ প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে)

বৃহস্পতিবার, ২৯ জুলাই, ২০২১

হেমন্ত দেবনাথ


 

          [মে (২০২১) মাসের সংখ্যার পর]                         


       " সত্যের পথে ভারতীয় দর্শনের অগ্রগতি"


                                                                                                                     -------- হেমন্ত দেবনাথ


           আস্তিক দর্শন গুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরার চেষ্টা করছি :-

 প্রথম সাংখ্য দর্শন নিয়ে আলোচনা করছি। এই দর্শনের প্রবর্তক ছিলেন মহর্ষি কপিল। এটি দ্বৈতবাদী দর্শন। কারণ 'পুরুষ' (Purush) ও প্রকৃতি' (Prakriti) কে এ দর্শন স্বীকার করে। পুরুষ চৈতন্যস্বরূপ, প্রকৃতিক অবচেতন বা জড় স্বরূপ। পুরুষ অপরিবর্তনীয়, কিন্তু সব পরিবর্তনের স্বাক্ষী। পুরুষ ও প্রকৃতির সংযোগে সৃষ্টি সম্ভব। তাই সৃষ্টিকর্তারূপে ঈশ্বর অস্বীকৃত। সাংখ্য দর্শন প্রাচীনতম দর্শন। সাংখ্য দর্শন মতে ভগবান লাভের উপায় হল তিনি প্রত্যক্ষ, অনুমান ও শব্দ।

      মহর্ষি পতঞ্জলি যোগ দর্শন এর প্রবর্তক। এটি ঈশ্বরবাদী। ঈশ্বরের সাথে যোগ হওয়া - এটি সাধন শাস্ত্র। বিবেক জ্ঞান লাভ করতে পারলে সব দুঃখের নিবৃত্তি হয়। 'চিত্তবৃত্তি'- এটি মূল আলোচ্য বিষয়। যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান, সমাধি - এই আটটি হল যোগাভ্যাসের স্তর। প্রত্যক্ষ, অনুমান ও শব্দ বা বিশ্বস্তব্যক্তির বক্তব্য - হল প্রমানণ বা জ্ঞান লাভের উপায়। 

    মহর্ষি গৌতম ন্যায় দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা। যথার্থ জ্ঞান লাভের পদ্ধতি নির্ণয় করাই -এ দর্শনের আলোচ্য বিষয়। এটি বস্তুবাদী আস্তিক দর্শন। প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান ও শব্দ - এই চারটি প্রমানের সাহায্যে জগতের যাবতীয় তত্ত্বকে তাঁরা ব্যাখ্যা করেছেন ।

       বৈশেষিক দর্শন ‘বিশেষ' নামক পদার্থকে এ দর্শনে মুখ্যত স্বীকৃতি দেবার জন্য এ দর্শনের নাম হয়েছে বৈশেষিক দর্শন। এ দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা মহর্ষি কণাদ। ন্যায় দর্শনের সব তত্ত্ব এখানে স্বীকৃত। বৈশেষিকগণ দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সামান্য, সমবায় বিশেষ ও অভাব – এই সাতটি পদার্থের মাধ্যমে জগৎ ও জীবনের প্রকৃত সত্ত্বা ব্যাখ্যা করেছেন। বৈশেষিকরা পরমাণুতত্ত্বে বিশ্বাসী প্রত্যক্ষ ও অনুমান এ দু'টি প্রমাণকে তাঁরা স্বীকার করেছেন।

         মীমাংসা দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা মহৰ্ষি জৈমিনি এরা ঈশ্বরবাদী নন। এঁরা বস্তুবাদী (Realist) ও বহুত্ববাদী (Pluralist)। তাঁদের মতে কর্ম অনুসারে জগৎ সৃষ্টি ও জীবের ফলভোগ হয়। তাঁরা বলেন, বেদ নির্দেশিত কর্মই হলো ধর্ম।

      বেদের শেষ অংশই বেদান্ত। বেদান্ত দর্শনের ভিত্তি হল উপনিষদ। এ পর্যন্ত ১১২ খানা উপনিষদের নাম জানা গেছে। কয়েকটি প্রধান উপনিষদের নাম হল - “ঈশোপনিষদ”, “কেন”, "কঠ", "ঐতরেয়" প্রভৃতি। প্রধান আলোচ্য বিষয় - ব্রহ্ম ও ব্রহ্মের স্বরূপ। বেদাস্তের অপর নাম 'ব্রহ্মসূত্র'। ব্রহ্মসূত্রের উপর বিভিন্ন ভাষ্য রচনা করেন - শঙ্করাচার্য, রামানুজ, বল্লভ প্রমুখ। অদ্বৈতবেদান্তবাদীগণ জ্ঞানলাভের উপায় হিসেবে প্রত্যক্ষ, অনুমান, শব্দ, উপমান, অর্থাপত্তি ও অনুপলব্ধি এই ছয়টিকে স্বীকার করেছেন।

        বিভিন্ন নাস্তিক দর্শন গুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচয়ের অবতারণা করছি :-

     ভারতের অতি প্রাচীন এক জড়বাদী নাস্তিক দর্শন হল চার্বাক দর্শন। ক্ষিতি (Earth), অপ্ (Water), তেজ (Light), মরুৎ (Air) এই চারটি জড় পদার্থের সমন্বয়ে জগৎ ও জগতের যাবতীয় বস্তু, এমনকি প্রাণ এবং মনও সৃষ্টি হয়েছে। আত্মা, ঈশ্বর, পরলোক, স্বর্গ, নরক, কর্মবাদ, জন্মান্তরবাদ- এ সব চার্বাক দর্শনে অস্বীকৃত। তাঁদের মতে- অর্থ (টাকা পয়সা) হল গৌণ পুরুষার্থ এবং ইন্দ্রিয় সুখ (কাম) হল মুখ্য পুরুষার্থ। "খাও-দাও-আনন্দ কর”- তাদের নৈতিক আদর্শ। মোক্ষ লাভ হাস্যাস্পদ ব্যাপার। প্রত্যক্ষই তাঁদের মতে জ্ঞানলাভের একমাত্র উৎস। চার্বাক নামে ঋষি মতান্তরে লোকপুত্র বৃহস্পতি - চার্বাক দর্শনের প্রবর্তক।

         জৈন দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা হলেন তীর্থঙ্কর ঋষবদেব, এই দর্শন নীরিশ্বরবাদী, অবৈদিক, অতীন্দ্রিয়লোকের সত্ত্বায় বিশ্বাসী। তীর্থঙ্করগণকে মানেন ও শ্রদ্ধা করেন। নিজেদের আকরগ্রন্থের প্রাধান্য স্বীকার করেন। সম্যক দর্শন, সম্যক জ্ঞান, সম্যক চারিত্র - এর মাধ্যমে মোক্ষ লাভে বিশ্বাসী। অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, ব্রহ্মচর্য্য, অপরিগ্রহ - এই পঞ্চ মহাব্রত পালন করেন তাঁরা। তাঁরা বলেন- প্রত্যক্ষ, অনুমান ও শব্দ (আপ্ত পুরুষের বাক্য) - তিনটিই যথার্থ জ্ঞানের উৎস।

           বৌদ্ধ দর্শনের মহর্ষি গৌতমই প্রবর্তক। বৌদ্ধ দর্শনের মূল ভিত্তি বুদ্ধের বাণী। প্রধান আলোচ্য বিষয় - মানুষের জীবন। দুঃখ-কষ্টের হাত থেকে কীভাবে মানুষ পরিত্রাণ পাবে - এটাই বৌদ্ধ দর্শনের আলোচনা। বৌদ্ধমতে জগতের সবকিছুই অনিত্য – কোন কিছুই চিরন্তন বা চিরস্থায়ী নয়। চারটি আর্যসত্য, জগতের অনিত্যতা, শাশ্বত আত্মার অস্থায়ীত্ব ইত্যাদি বৌদ্ধ দর্শনের মূল কথা। জ্ঞান লাভের উপায় হল প্রত্যক্ষ ও অনুমান। বৌদ্ধ দর্শনের চারটি সম্প্রদায় রয়েছে সৌত্রাস্তিক (বাহ্যনুমেয়বাদী ও হীনযানবাদী), বৈভাষিক (বাহ্যপ্রত্যক্ষবাদী ও হীনযানবাদী), মাধ্যমিক বা শূন্যবাদ, (এরা মহাযানবাদী), যোগাচার বা বিজ্ঞানবাদী (এরাও মহাযানবাদী) হীনযানবাদীরা বস্তুবাদী এবং মহাযানবাদীরা হলেন ভাববাদী ।

        আমরা ভারতীয় দর্শনের একটি বিশেষ মতবাদ জানতে গিয়ে অন্যান্য মতবাদ গুলোর সাথেও পরিচিত হই। প্রতিটি দর্শন নিজ মত প্রতিষ্ঠার আগে বিরোধীপক্ষের মতবাদটি ব্যাখ্যা করেছেন। একেই বলা হয় “পূর্বপক্ষ"। এরপর যুক্তির সাহায্যে পূর্বপক্ষকে সমালোচনা ও "খন্ডন" করা হয়েছে। একে বলা হয় "উত্তরপক্ষ" (সিদ্ধান্ত)। বেদ ও উপনিষদকে কেন্দ্র করেই ভারতীয় আস্তিক দর্শনের উদ্ভব ও বিকাশ হয়েছিল। বেদ ও উপনিষদের পরে ভারতে যে ছ'টি আস্তিক দর্শনের আবির্ভাব ঘটেছিল; তা হল – (i) সূত্র (ii) ভাষ্য এবং (iii) টীকা- এ তিনটি পর্যায়ে ক্রমবিকশিত হয়েছিল ।

          ভারতীয় দর্শনে বড়ো বড়ো কঠিন বাক্যগুলোকে ছোটো ছোটো অৰ্থপূৰ্ণ বাক্যে প্রকাশ করাকে বলে সূত্র। সূত্র গ্রন্থই ষড়দর্শনের আদিগ্রন্থ। সাংখ্য দর্শনের আদি গ্রন্থ হল কপিলের সাংখ্যসূত্র, বৈশেষিক দর্শনের আদি গ্রন্থ হল কণাদের বৈশেষিক সূত্র। বেদান্ত দর্শনের মূল গ্রন্থ বাদ্রায়নের ব্রহ্মসূত্র ইত্যাদি। সূত্র গুলো এতো সংক্ষিপ্ত ছিল বলে অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত অর্থ বোঝা কঠিন হতো। এর ফলে রচিত হত ভাষ্যগ্রন্থ। যেমন – বৈশেষিক সূত্রের ভাষ্য রচনা করেন প্রশস্ত পাদ। যে সব ভাষ্যের ব্যাখ্যা অস্পষ্ট, সে ক্ষেত্রে ভাষ্যেরও ভাষ্য রচনা দরকার হল। তাই রচিত হল টীকা। যেমন ন্যায় দর্শনের প্রখ্যাত টীকাকার হলেন বাচস্পতি মিশ্র এবং তাঁর লেখা টীকা পুস্তকের নাম হল – “ন্যায়বার্তিক তাৎপর্য টীকা"। নাস্তিক দর্শন গুলোর কোনও সূত্র বা ভাষ্যগ্রন্থ নেই।

             ভারতীয় দর্শন শুরুতে দুঃখবাদী বা নৈরাশ্যবাদী হলেও পরিণামে আশাবাদী। নিয়ম শৃঙ্খলায় বিশ্বাস, আধ্যাত্মিক অতৃপ্তি, ত্যাগ ও মোক্ষলাভের আদর্শ, ব্যবহারিক প্রয়োজনবোধ ইত্যাদি অপরিমিত ও অভূতপূর্ব বৈশিষ্ট্যে ভারতীয় দর্শন সমুজ্জ্বল। “সকল জীবকে সমান চোখে দেখা", "মানুষের প্রতি আমাদের কর্তব্য যেমন আছে, তেমনি মানুষেরও কর্তব্য হল আমাদের অধিকারকে অক্ষুন্ন রাখা"- এরকম উচ্চতর সামাজিক দায়বদ্ধতা ও সামাজিক নীতিশিক্ষাও দেয় ভারতীয় দর্শন। ভারতীয় আস্তিক কিংবা নাস্তিক যে-কোন দর্শনই হোক না কেন, সেগুলো মোটেই বিচার-বিযুক্ত নয়। সেগুলোতে রয়েছে চর্চা ও চর্যার সমন্বয়, রয়েছে জীবনবোধের স্পর্শ। হৃদসম্পদে সমৃদ্ধ দর্শন গুলোতে রয়েছে আশাবাদের প্রাণস্পন্দনতা।

1 টি মন্তব্য:

  1. As per my knowledge a little magazine, as well as any paper can be a remarkable & richfull when it posses,published along with some Researchable article's & noking issues to the new erra of any significant field. I would be thanks🌹 to Kabi Hemanta Nath for this Researchful article & for his laborious job for we the all readers of this e-megazine "NAYAN"! I wish his every success in his next article's !! Lots of thanks🌹 !!---
    Chandra lal Nath
    Dasda, Now at Dhaleswar,Agartala.

    উত্তরমুছুন