সাহিত্য নয়নে আপনাকে স্বাগত
"সাহিত্য নয়ন" সাহিত্য পত্রিকায় আপনাকে স্বাগত। ( প্রকাশকের লিখিত অনুমতি ছাড়া এই পত্রিকার কোন অংশ কেউ প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে)
সোমবার, ২২ জুন, ২০২০
সম্পাদকীয়
প্রিয় পাঠক, অনেক আশা এবং স্বপ্ন জড়িত একটি নতুন সংখ্যা নিয়ে আবার হাজির হলাম আমরা। দাবদাহ গ্রীষ্মে খরতপ্ত রোদে প্রচন্ড দহন দাহনে যখন মানুষ কামনা করে শান্ত নীড়ের স্নিগ্ধতা, তখনই ধরণীর বুকে আনন্দ-ধারার মতো নেমে আসে মেঘমন্দুরা বর্ষা। বর্ষার আগমন আসলে বৃষ্টির মঙ্গলধ্বনি। বর্ষাকাল মানে ঝুমুর ঝুমুর বৃষ্টি। সবুজে সবুজে আর নীলিমায় নীল আমাদের দেশের প্রকৃতি গেয়ে উঠেছে বর্ষামঙ্গল। বর্ষার আগমনে সহসাই মন নেচে ওঠে ময়ূরের মতো করে। প্রিয়জনের সান্নিধ্য পাওয়ার আশায় ব্যাকুল হয়ে ওঠা মন কিছুতেই ঘরে বসে থাকতে চায় না। নিজের অজান্তেই কেউ গেয়ে উঠে মেঘলা দিনের গান------"এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকেনা তো মন, কাছে যাবো কবে পাবো ওগো তোমার নিমন্ত্রণ। তাইতো বর্ষাকে আমরা এতটা ভালবাসি। বর্ষা জীবনের স্বপ্ন দেখায়, বর্ষার ছোঁয়ায় গ্রাম বাংলা হয়ে ওঠে রূপসী। আমাদের দেশের বৈষ্ণব কবি থেকে শুরু করে আধুনিক কবি-লেখক সকলের মনকে প্রভাবিত করেছে সুন্দরী বর্ষারানী। কবি ও লেখকদের ভাবনায় বিভিন্ন রূপে ফুটে উঠেছে বর্ষার ছবি। আর তাই বর্ষার মঙ্গলময়ী রূপের কথা স্মরণ করে, বিশেষ কিছু করার ইচ্ছা থেকে প্রকাশিত হলো সাহিত্য নয়নের " বর্ষামঙ্গল উৎসব" নামক তৃতীয় সংখ্যা। আমাদের সম্মানিত কবি-লেখকদের লেখনীর ছোঁয়ায় এবং কবি ও প্রচ্ছদশিল্পী কবিতা সরকারের অংকিত প্রচ্ছদে সংখ্যাটি পেয়েছে পূর্ণতা। অনেক বক্ বক্ করলাম, আর বাকি কথা হবে আগামী সংখ্যায়।
রাজেশ ভট্টাচার্য্য
সম্পাদক, সাহিত্য নয়ন
অমল কুমার মাজি
পরবাসে
----- অমল কুমার মাজি
বৃষ্টি-বাদল বাজায় মাদল
মেঘের গরজনে.........
বাজল সেতার মল্লারে কার
হাতের পরশনে।
নূপূর পায়ে আসল ধেয়ে
বিজ্লী-বরণ চপল মেয়ে
চরণে তার ছন্দ জাগে
খুশীর বরষণে।
উদাস কবি বাহির পানে
তাকিয়ে কেন কেউ কি জানে
চোখের পাতা ভিজল কি তার
প্রিয়ার অদর্শনে।
এমন ভরা শ্রাবণ মাসে
একলা ব'সে দূর প্রবাসে
কোন কবিতার খোঁজ করে সে
আজকে নিরজনে।।
হেমন্ত দেবনাথ
কবিদের ভাবনায় 'বর্ষা ও বর্ষামঙ্গল'
-------হেমন্ত দেবনাথ
ঋতুরঙ্গমঞ্চে স্বমহিমায় যে ছুটে আসে, সে ''শ্যাম গম্ভীর বরষা"। মেঘের মৃদঙ্গ বেজে উঠে গুরু গুরু রবে। ঝড়ো হাওয়ায় উতলা হয়ে বারিধারা "ঝর ঝর ঝরে"। কখনো মুষলধারে, কখনো রিম্ ঝিম্ নূপুর নিক্বনে। মেঘ মেদুর মায়াবী ছায়ায় আচ্ছাদিত হয় পথ-পার্ক-গাছ-গাছালি ও বনবীথি।
বর্ষা শ্যামাসুন্দরী। তার সজল শ্যামশোভা, বৃষ্টিঝরা মেঘ-কাজল দিনটির মায়াবী শোভা বড়ই অনুপম। বর্ষা যেন অনুপম সৌন্দর্য ও ভয়ংকরের সমন্বয়ী রূপ। তবুও বর্ষা মানুষের মনোজগতে সঞ্চারিত করে আবেগ, নতুন ভাব, উদ্দীপনা ও সৃষ্টিশীল মনোভাব। যুগে যুগে তাই বর্ষার কত অপূর্ব ছবি এঁকেছেন কবি ও শিল্পীরা। বর্ষালগনে কবি মনের অন্তর্লোকের নিবিড় বার্তাটি আমাদের প্রাণবন্ত করে-----" হাজার বৎসর পূর্বে কালিদাস সেই যে আষাঢ়ের প্রথম দিন কে অভ্যর্থনা করেছিলেন এবং প্রকৃতির সেই রাজ্যসভায় বসে অমর ছন্দে মানবের অমর সঙ্গীত গেয়েছিলেন, আমার জীবনেও প্রতি বৎসর সেই আষাঢ়ের প্রথম দিন তার সমস্ত আকাশজোড়া ঐশ্বর্য নিয়ে উদয় হয়।"
"মেঘদূত" কাব্যগ্রন্থে যক্ষের বিরহ বার্তা, যক্ষ-প্রিয়ার বেদনা কালিদাসের লেখনীতে বাঙ্ময় উঠেছে। যক্ষের কাছ থেকে বার্তা নিয়ে মেঘ পৃথিবীর নানা দেশ, প্রকৃতি, নদী পেরিয়ে প্রিয়ার কাছে পৌঁছায়। আর যক্ষ-প্রিয়া অনুভবের আবেশে প্রণয়ী যক্ষের স্পর্শ লাভ করেন। মহাকবি কালিদাস সংস্কৃত ভাষায় লিপিবদ্ধ করেছেন। আর বাঙালির হৃদয়ে কাব্যগ্রন্থ খানার প্রভাব ফেলেছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। কারণ তিনিই ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে "মেঘদূত"- এর ছন্দোবদ্ধ বাংলা অনুবাদ করেছিলেন। বিরহের দৃষ্টিতে বর্ষাকে চিত্রিত করেছিলেন কালিদাস। বাংলা কাব্য সাহিত্যে "মেঘদূত" কাব্য খানার গুরুত্ব অপরিসীম। রবীন্দ্রনাথের কন্ঠে অনুরণিত হয়েছিল :-- ----" বহু যুগের ওপার হতে আষাঢ় এল আমার মনে। কোন্ সে কবির ছন্দ বাজে ঝরঝর বরিষণে।।"
আমাদের দেশের বৈষ্ণব কবিরাও বর্ষার অভূতপূর্ব বর্ণনা করেছেন। শ্রীকৃষ্ণ প্রণয়িনী শ্রীরাধার 'অভিসার' পর্যায় বৈষ্ণব কবির বর্ষা বর্ণনা ফুটে উঠেছে :--
-----" তহি অতি দূরতর বাদল দোল। বারি কি বারই নীল নিচোল।।"
বর্ষায় মেঘমেদুর বিষন্ন দিনগুলোতে হৃদয় মন কেন যে অহেতুক বিয়োগ-বেদনায় হয় অধীর ! বিরহিনী শ্রীরাধার অন্তর্বেদনা রূপ নিয়ে চিরন্তন বিয়োগ-বেদনায় :--
-----" এ সখি হামারি দুঃখের নাহি ওর। এ ভরা-বাদর মাস ভাদর শূন্য মন্দির মোর।"
শুধুমাত্র বৈষ্ণব কবিরাই নন। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, মোহিতলাল মজুমদার, এমনকি বঙ্কিমচন্দ্রও বর্ষার বর্ণনায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন। আকাশে মেঘ কবি নজরুল আপ্লুত হয়ে লিখলেন :-
----- "........ ছিটিয়ে মেঠো জল খেলেন যে অবিচল কাজলা দীঘির জলে ঢেউ তোলে-- আনমনে পদ্ম-পাতার থালিকা।
মেঘের সাথে বিদ্যুতের জলসানি আর কাল আকাশের দিকে চেয়ে নজরুল লেখনি ধরলেন :-
---" খেলে চঞ্চলা বরষা বালিকা মেঘের এলো কেশে ওড়ে পূর্বালি ....................বলাকার মালিকা।"
বর্ষার আবির্ভাবে মানব-মনে বিরহ-বেদনার উদ্রেক হয়, যদি না প্রিয়া কাছে থাকেন। তাই কবি নজরুলের কণ্ঠে শোনা গেল :-
----" যে দেশে যবে বাদল ঝরে কাঁদে না কি প্রাণ একেলা ঘরে, বিরহ
ব্যথা নাহি কি সেথা বাজে না বাঁশি ...................................নদীর তীরে।"
বিশ্ববন্দিত কবি রবীন্দ্রনাথও তার "জীবনস্মৃতি" গ্রন্থ লিখেছিলেন :-
-----" মনে পড়ে শ্রাবণের গভীর রাত্রি, ঘুমের ফাঁকের মধ্যে দিয়ে ঘন বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ মনের ভিতরে সুপ্তির চেয়েও নিবিড়তর একটা পুলক জমাইয়া তুলিতেছে..........।" কবি চেতনে-অবচেতনে স্বপ্নে-জাগরণে যেন বর্ষার পিছু পিছু ছুটেছেন। কত ভাবে, কত রূপে, কত বিচিত্র ভাষায় যে রবীন্দ্রনাথ বর্ষাকে অনুভব করেছেন তা ভাবলে সত্যি আশ্চর্য হয়ে যেতে হয়।
বর্ষার প্রথম আবির্ভাবক্ষণে কবি রবীন্দ্রনাথ বর্ষাকে স্বাগত জানালেন :-
-------" আনো মৃদঙ্গ মুরজ মুরলী মধুরা, বাজাও শঙ্খ হুলুরব করো বধূরা,
এসেছে বরষা, ওগো অনুরাগিনী।"
বৃষ্টির সাথে কবি মনের একাত্মতা তার সংগীত এই ফুটে উঠেছে :-
----" ওরে বৃষ্টিতে মোর ছুটেছে মন, লুটেছে এই ঝড়ে
বুকে ছাপিয়ে তরঙ্গ মোর কাহার পায়ে পড়ে।"
বর্ষার আবির্ভাবে বিরহ-বেদনার উদ্রেগ কবি সঙ্গীতেও ফুটিয়ে তুলেছেন :-
----" এসো শ্যামলও সুন্দর, আনো তব তাপহরা তৃষাহরা সঙ্গসুধা।
বিরহিনী চাহিয়া আছে আকাশে।"
ঝড়ের রাতে চলে কবির প্রেয়সীর অভিসার :-- ---" আজি ঝড়ের রাতে, তোমার অভিসার পরান সখা বন্ধু হে আমার।"
বর্ষার বৃষ্টিধারার কল্যাণময়ী রূপও রবীন্দ্রনাথের কাব্য-গাথায় ফুটে উঠেছে:-
----" তোমার মন্ত্রবলে পাষাণ গলে, ফসল ফলে-
মরু বহে আনে তোমার ফুলের ডালা....।"
কবি মোহিতলাল মজুমদারের কন্ঠে " কালবৈশাখী" কবিতায় শোনলাম:--
---" ওরি মাঝে আছে কাল-পুরুষের সুগভীর পরামর্শ।"
কবি অক্ষয় কুমার বড়াল, কবি জীবনানন্দ দাশ প্রমুখ অনেক কবি বর্ষা নিয়ে লিখেছেন, তুলির টানে শিল্পীর হাতে বর্ষা প্রতিধ্বনিত হয়েছে। বর্ষায় আছে প্রাণের নিবিড় একাত্মতা। বর্ষার শ্যামল-কোমল স্পর্শে মানুষের মনোলোকে হয় সরস, আনন্দে উদ্বেল। মানুষের উৎসবাদির মধ্যে, সংস্কৃতির কর্মধারায়, চিন্তা-চেতনায় তার আনন্দ উদ্দীপনার বহিঃপ্রকাশ। ঐক্যের উৎস ঝুলনোৎসব ও রাখি বন্ধন হয় বর্ষার শ্রাবণী পূর্ণিমায়। বর্ষার বোধনযজ্ঞে আমরা উদ্বেলিত হই, পালন করি 'বর্ষামঙ্গল উৎসব'। বর্ষার মধ্যেই আমরা খুঁজে পাই জীবনের নববিধান। তাপদগ্ধ পৃথিবীর বুকে নেমে আসে নবজীবনের আশীর্বাদের মতন বর্ষা । তাই বর্ষামঙ্গল উৎসবলগ্নে কবিগুরুর কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে আমাদের প্রার্থনা হোক:-
------ "......... হৃদয় বিমল হোক্, প্রাণ সবল হোক্, বিঘ্ন দাও অপসারী। কেন এ হিংসা দ্বেষ, কেন এই ছদ্মবেশ কেন এ মান-অভিমান। বিতর বিতর প্রেম পাষাণ হৃদয় জয় জয় হোক্ তোমারি।"
কিশোর কুমার ভট্টাচার্য
বর্ষা
-----কিশোর কুমার ভট্টাচার্য
আবহাওয়ার পূর্বাভাস ;--
ভারতীয় উপমহাদেশে
দক্ষিণ পশ্চিম মৌসুমি বায়ু
আসিতেছে যথাসময়ে৷
শুনিয়া এ বারতা
ভারতমাতার সন্তান
মনে মনে রচিল
নতুনের গান৷
জ্যৈষ্ঠমাস যবে
তাহার লীলায় টানিছে ইতি
দখিনা পবন বহিল জোরে
পালে লাগিলো গতি৷
দেখিয়া তিন-চারিদিনের
দখিনা বায়ুর জোর
বৃদ্ধপিতা বলিলেন,
সাগর হইতে উঠিছে জল
নামিবে বাদলের ঢল৷
পুকুর ঘাট- পাড় শীঘ্র
সারাই করিয়া লহো
ডিঙিখানি ঘাটের কিনারায়
আনিয়া বাঁধিয়া রাখো৷
বৃদ্ধামাতা বলিলেন,---
সপ্তাহখানিকের চাল,ডাল,তেল,লবণ
যাহা প্রয়োজন
আনিয়া রাখো গৃহে,
বর্ষা নামিলে কী ঘটিবে
বলিতে পারিবে কি হে?
যেমনি ফরমান তেমনি কাজ
সমস্ত আয়োজন হইলো সারা
বরষিল ঘনধারা
মাঝে মাঝে গরজিল বাজ৷
একটানা বরিষণে
ডুবিল পথ-ঘাট,
ধান্যক্ষেত্র হইলো হাওড়;
ভেলায় ভাসিল কিশোরী- কিশোর ৷
জালহাতে গ্রাম্য যুবক
কাটাইলো নিশি
ভরিলো থলি
প্রথম অবতারে৷
বন্যার জলে ভাসিল গ্রাম
নিমজ্জিত ঘর - বাড়ি
শরণার্থী শিবিরে আশ্রিত মাঝে
বণ্টিত হলো গুড়,চিড়া,মুড়ি৷
বন্যার জল নামিলে
যে যাহার গৃহে ফিরিলো
সকল যাতনা ভুলিয়া
পৃথ্বীরে নতুনে সাজাইলো৷
মিঠু মল্লিক বৈদ্য
মেঘবালিকা
-----মিঠু মল্লিক বৈদ্য
মেঘবালিকা, অরূপ তোমার সাজ;
কাজল টানা চোখ;
মেঘবর্ণ অবয়ব,
ঝড়ে মুক্তো হাসি
বরষা ভরা,ভর-দুপুরে।
যদি বল,প্রেমিক হতে পারি।
অবহেলার স্বপ্ন ভুলে ;
বিলীন হবো সৌন্দর্যে;
ভালোবাসার পূণ্য ধারায়
তীব্র বেগে ঝড়বো দুজনে।
বল যদি,পাহাড় হবো
খেলবো প্রেমের লুকোচুরি,
ভাসবে ; ডানা মেলে
সূদুর ঐ নীলদিগন্তে,
লাজুক চোখে,মিষ্টি হেসে
ঝড়বে মোর কলেবরে।
যদি বল,আকাশ হবো,
যেথা খুশী, সেথা যাবে ভেসে;
আলতো করে,হাত বুলাবো
তোমার লজ্জা-রাঙ্গা আস্যে।
ভালোবাসার চোখ-রাঙ্গিয়ে
নেবো বুকে টেনে।
নীরদবর্ণ মেঘবালিকা!
বলো যদি;হবো নভশ্চর,
দ্বিধাহীন চিত্তে,ছুটবো তব পানে;
বৃষ্টি রূপে,ঝড়বে যবে তুমি;
যুগল ডানা, দেবো বিছিয়ে।
যদি বল,বাতাস হবো,
নিদানকালে,সঙ্গী হয়ে
ঝঁপিয়ে পড়বো দিঘির জলে
তব স্মিতহাস্যে;থাকবো দুজনায়,
একে অপরের হয়ে।
বলো যদি,হবো ঊর্মিমালী,
তব খরশান অম্বুধারা;মিশবে আমাতে,
যাব বিলীয়ে ;অথৈই তলে,
থাকবো সুখে,একে অপরের মনন্তরালে।
এমনি করে,ভাবি তোমায়
আনমনা দুপুরে,চৈতের দিনে
বিষাদ -ভরা, যাতনা যত
দেবে ধুঁয়ে, অমৃত ধারায়।
স্তব্ধ অবনী;হবে খরস্রোতা
তব রিমঝিম সুরের মূর্ছনায়।
অমিতাভ চক্রবর্তী
মেঘের ডানা
-----অমিতাভ চক্রবর্তী
খোলা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে নয়ন সম্মুখে,
বারিধারার দৃশ্য দিগন্ত বিস্তৃত মাঠের মাঝে।
ভরা গ্রীষ্মের বিকেল বেলায় বইছে সমীরণ,
আকাশ জুড়ে মেঘের ডানা যেন বর্ষার আগমন।
দিনের ব্যস্ততার মাঝে জীবনের চলার গতি,
মেঘমালার আড়ালে সান্ধ্যকালীন প্রস্তুতি।
রাতের জোনাকির আলোয় খুঁজে পাওয়া জলরাশি,
স্বপ্নের বালুচরে দেখা দেয় আলোর উঁকি।
মেঘের জলপাত্রে আবদ্ধ মধ্যাহ্নের সূর্য রশ্মি,
গাছের পাতার আড়ালে পাখিদের দিনলিপি।
আগামীকাল হয়তো সরে যাবে এই ঘনঘটা,
নতুন আঙ্গিকে হবে নতুন দিনের সূচনা।।
অভিষিক্তা রায়
আমার বৃষ্টি
--------অভিষিক্তা রায়
আজ সারাদিন অঝোর ধারায় মন কেমনের দিস্তা
পাতায় পাতায় বৃষ্টির ফোঁটা বর্ষা জলের তিস্তা
জলে ভেজা আমার শহর,জানালার কাঁচে বৃষ্টি ছাঁট
হেঁটে চলে ব্যস্ত জীবন,জল থইথই পথের বাঁক।
মন খারাপের জলের ধারায় ঠোঁট ছুঁয়েছে বৃষ্টিজল
চোখের পাতায় ভারী বর্ষণ চুঁয়ে পড়ছে অবিরল
মেঘের পরে দুরন্ত মেঘ জমিয়ে কোন বিবর্ণ আবেগ
বাউলের ওই একতারাটায় বাজায় স্মৃতির মল্লার রাগ।
দুপুর ভীষণ অভিমানী,দুপুর বড়ই স্বার্থপর
একলা পেলেই আমায় ডাকে হাত বাড়িয়ে তেপান্তর
শান্ত মনের স্তব্ধ পথে অবিরত মেঘের নূপুর
এক পৃথিবী প্রাণোচ্ছল আমার,আরেক পৃথিবীতে উদাসী দুপুর।
কেউ বা ভেজায় শরীরটাকে কেউ বা আবার স্নিগ্ধ মন
তপ্ত মনে তৃপ্তি আসুক বারি ধারায় কিছুক্ষণ
অতীত হলেও স্পষ্ট দেখি ঘষা কাঁচে আবছা জল
তরী ভাসুক তীরের টানে,মনে তৃষ্ণার জল টলমল।।
গৌতম নাথ
তুমি সেই বসন্ত চন্দ্রিমা
------ গৌতম নাথ
আবারও যদি বলো অপেক্ষার কথা তবে বুকের আলিঙ্গনটায় আবারও শ্রাবণ মেখে নেব।
চিরপ্রস্থান কতদূরে বিসর্জনের আলপনা আঁকছে জানা নেই , তবে এটুকু বুঝি আমার ঘনিষ্ঠ বুকটা কখনও অচ্যুতের শীতলতা মানে না।
আধভেজা বর্ষাচোখে আমি সরল অপেক্ষাতেই ঝর্ণার স্বপ্ন সাজাই।
যে অসীমতায় আগমনীর আয়োজন করি তাতে কখনও সর্বনাশের আঁচ লাগে না।
উষ্ণতার মানেই যদি উবে যায় তবে ওমের পাশে মিছিমিছি কেন যামিনী যাপন?
সকল সম্পর্ক তো আর অভিধানে স্থান পায় না , অক্ষরেও সাজানো যায় না।
একটা মহাশূন্য পরিপূর্ণতায় যার সাথে উদয়স্ত গাঁট বাঁধা টানাপোড়েন তাঁকে কি নামে নগ্ন করি?
ঘর মানেই তো যাপন ক্রিয়া , অঘরেও তুমি যে আমার রক্তক্ষয়ী অনামিকা সুখ।
পহেলী মুখার্জী
বর্ষা
-----পহেলী মুখার্জী
সারা বছর প্রকৃতিকে রুক্ষ ও ধূলো মলিন করে রাখে বাকি পাঁচ ঋতু।আর বর্ষা এসেই সবকিছু ধুয়ে মুছে প্রকৃতিকে গড়ে তোলে সজীব ও সতেজ।প্রতিটি ঋতুতেই নতুন রূপে ধরা দেয় প্রকৃতি।তাই হয়তো প্রকৃতি ও বর্ষার ঋণ শোধ করতে উঠে পড়ে লাগে।রূপের মাধুরীতে রাঙায় নিজেকে।
বর্ষা কাব্যের ও প্রেমের।শত ব্যস্ততার ভীড়েও ভালবাসার সাধ জাগে এই সময়ে।প্রকৃতির বৃষ্টি স্নানের সাথে সাথেই উপচে পড়ে পদ্মপুকুর।ঝড়ে যায় গ্রীষ্মের ফুল ,জেগে ওঠে বর্ষায় নতুন পাতা,নতুন ফুল।বিশেষ করে ,জুঁই,বেলী,টগর,গন্ধরাজ,যে কাউকে বাঁধে মায়ার বাঁধনে ।বর্ষা এলে যেমন প্রকৃতি শুদ্ধ হয়,তেমনি দূষিত নদীগুলিও ফিরে পায় প্রাণ।
বর্ষার আগমন মানেই খরা,তাপের বিদায় আর গাছে গাছে কচি পাতা ,ও ফুলের সুভাষে বিশুদ্ধ চারপাশ।
আষাঢ় ও শ্রাবন এই দুই মাস নিয়েই বর্ষাকাল।রিমঝিম বৃষ্টি,একরাশ সজীবতা আর কদম ফুলের সুভাষ নিয়ে হাজির হয় এই বর্ষাকাল।
পৃথিবীর আর কোনো দেশে ঋতু হিসেবে বর্ষার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বা নাম নেই।এই ঋতু যেন শুধুই আমাদেরই ঋতু।
তাই বর্ষা কবিদের ঋতু।নজরুল,রবীন্দ্রনাথের ঋতু।বৃষ্টির সঙ্গে আমাদের প্রেম আদিকাল থেকেই।বৃষ্টি আমাদের প্রথম প্রেমিক,প্রথম প্রেমিকা।বর্ষায় জমে ওঠে অনন্য প্রেম।বর্ষা নিয়ে রচিত হয়েছে কতো যে গল্প,কবিতা,গান,তার কোনো ইয়ত্তা নেই।তায় বাঙালির শ্রেষ্ট কবিতা বর্ষার কাব্য।বর্ষাকে অবলম্বন করেই
আমাদের প্রেমের কবিতা।আমাদের প্রকৃতি বর্ষা এলেই নতুন করে সাজে ,যেনো কবির ঘরে প্রবেশ করে নতুন বউ।আর সেই নতুন বউকে ঘিড়ে একের পর এক কবিতা লিখে যায় কবি।যেখানে থাকে প্রেম ,বিরহ,অভিমান,ও রোমাঞ্চ।এসব মূলত জনজীবনেরই অংশ।
একজন কবি প্রকৃতিকে দেখেন খুব কাছ থেকে।তখন সেই প্রাণবন্ত লেখা শান্তির পরশ রেখে যায় আমাদের প্রাণে।এভাবে সাহিত্যের সঙ্গে আমাদের প্রাণের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মূলত প্রকৃতির সঙ্গে গড়ে ওঠে এমন সম্পর্ক যা স্থাপন করে দিতে পারেন কেবল একজন সাহিত্যিকই।
এক কথায় বর্ষা আর রবীন্দ্রনাথের কবিতা ,ও গান যেন একই ধারাই প্রবাহিত।
সুকমল গুপ্ত
বৃষ্টি
------ সুকমল গুপ্ত
আজ দুপুর থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে,,
প্রচন্ড ঝড়ো হাওয়া,
বিদ্যুৎচমক, সাথে গুরুগম্ভীর বজ্রপাত,
এ যেন মনে হচ্ছে ,
প্রকৃতির রাজ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক হিসেবে
জাহির করতে চাইছে নিজেকে।।
খনিকের মধ্যেই শান্তি, যেন
একটু হাঁপছেড়ে বাঁচা,
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা,
হ্যাঁ, বৃষ্টির কথাই বলছি।
দশভূজার মতো সর্বগুণ সম্পূর্ণা,
যেন আপন তৎপরতায় চালিয়ে যাচ্ছে,
প্রকৃতিকে নবরূপে সাজাবার যজ্ঞ।।
এ কাজ যেন একমাত্র তার-ই সাজে।
সে-ই যেন দীক্ষা গুরু,এই বিশ্ব সংসারের,
সে-ই যেন সৌন্দর্যতার আরেক নাম,
যেন ভালোবাসার বিশুদ্ধতম রূপ,
যার নির্মল প্রেম চিত্তে
ডুবে রয়েছে পৃথিবীর প্রতিটি মানব- মানবী।
যার আশ্রয়ে বিলীন হয়ে যায় চোখের জল
প্রকাশিত হয় শুধুই হাসি,
যার আশ্রয়ে সিক্ত হয় তৃষ্ণার্ত হৃদয়।।
বিশেষণ প্রয়োগ আমার জানা নেই,
শুধু জানি ,
তার এই বিশালত্বকে ব্যাখ্যা করার সামর্থ,,
আমার নেই।
এক পসলা বৃষ্টির পর,
স্নিগ্ধ , শান্ত, মনোরঞ্জক এই পরিসর
ছোট বড় গাছ গুলোকে দেখে মনে হল
ওরা হাসছে,,,! খেলছে,,, !
ওরা ,,মনের কথা খুলে বলছে,
নিজেদের মধ্যে,,,,!
ঝেড়ে ফেলে , ধুইয়ে নিয়েছে ,
সমস্ত পুরাতন।।
সন্ধ্যার ঠিক আগ মুহূর্তে ,
মেঘ ডাকার মৃদু শব্দ , থেমে থেমে শোনা যাচ্ছে
কিছুক্ষণ পর পরই।।
হালকা বাতাস , যেন একটু বেশিই স্নেহ দিয়ে
বয়ে যাচ্ছে গায়ের ওপর দিয়ে,
ঝিরঝির বাতাসে পাতার নাচ,
অনেক দূর থেকে ভেসে আসা পাখির সুর,,
ফুরফুরে মেজাজে চলছে ওদের মত বিনিময়,
ওরা যেন বলতে চাইছে - আমরা ভালো আছি।।
ক্রমে ঘনিয়ে আসে রাতের অন্ধকার,
সুদূর পশ্চিম দিগন্তে ,,
মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকা লাল রং,
ধীরে ধীরে হারিয়ে যায় তামসীর করাল গ্রাসে।।
কলি দেব নাথ
অপরূপ বর্ষা
------- কলি দেব নাথ
ক্লান্ত ধরণীর বুকে শান্ত ভাষা,
বয়ে নিয়ে আসে অপরূপা বর্ষা।
নবীনা সুভাষিতা কোমল হৃদয়,
সিক্ত ধরণীর যৌবন আলোয়।
দিগ দিগন্তের সবুজের খাসা,
কিষান হৃদয়ের চির প্রত্যাশা।
আকাশে বাতাসে অপরূপ দৃশ্য,
সিন্ধু- তটিনী প্রেম উন্মাদে ভাস্য।
খালে বিলে ভাসে কলমীর লতা,
কবির প্রাণে জাগে ছন্দের গাঁথা।
ফুলে ফলে সজ্জিত পরন্ত বেলা,
আকাশে গুরু গুরু মেঘের খেলা।
মরা গাঙে ভাসে জোয়ারের জল,
যৌবন নিয়ে আসে উদ্যম ঢল।
আকুলিত মেঘরাশির দুরন্ত পণা,
মাঝপথে অনাহুত চিলের হানা।
বরষে সরসে জাগে অঙ্কুর কণা,
হৃদ মাঝারে ভরে নৃত্যের দানা।
শন শন বাতাসের টলটল জলে,
স্মৃতির দুয়ার ভিড়ে পাল তুলে।
বিগলিত বর্ষার প্রগলিত ধারায়,
কখনো বয়ে যায় নিদারুণ বন্যায়।
তবুও উচ্ছসিত প্রাণের সাদর বেষ্টন,
নন্দিত ধরণীর সিক্ত আলিঙ্গন।
কবিতা সরকার
বর্ষা নানারূপে
----- কবিতা সরকার
কোনো এক মাতাল করা বর্ষা দিনে
যখন মেঘ ছুটছে মাথার পড়ে
খেলছে রোদ লুকোচুরি
মেঘের সাথে বাঁশ বাগানে ।
যখন হিজল আর তমাল বনে
বৃষ্টি ফোঁটায় মুক্তো ঝরে
তখন আমি সুর বেঁধেছি
বর্ষা রাগে আপন মনে ।
হঠাৎ এক দমকা হাওয়া
করলে আঘাত আমার পানে
চেয়ে দেখি পিছন ফিরে
ভাসছে বাসা অথই জলে ।
ভাসছে কত গরু বাছুর
জমানো সব শস্য কত
কত বাড়ির উড়লো চালা
ভাঙলো সেতু গাছের মতো ।
দিশেহারা মানুষগুলো
ছুটছে সব বাঁচার টানে
কেহ বা বুঝছে এখন
ঘটলো সবই তাদের ভ্রমে ।
এত ব্যাথা ছিল মা তোর
লুকানো কোন হৃদয়ে
দিলি সব উজাড় করে
সাত দিনেরই অশ্রুজলে ।
রাহুল নাগ
মন পাখি
------রাহুল নাগ
মন পাখি ডাকে , কত ছবি আঁকে।
লাল নীল স্বপ্নের তুলিকা।
জানালার কাচে বৃষ্টির ফোঁটা
ভেসেউঠে প্রেমিকার মুখটা।
দুপুর বেলা খাবার পরেই,
ঘুমিয়ে ছিলাম যখন ঘরে।
মন জানালায় উকি দিয়ে কে !
দিয়েগেলো ভালোবাসার বার্তা।
লাল,নীল,হলুদ কত রঙে,
সাজালো মোর মন জানালা।
আমি যাকে খুঁজি আকাশে, বাতাসে
আজ সেই আছে মনে বাসা বেঁধে।
পবিন্দ্র দেবনাথ
বর্ষা
------পবিন্দ্র দেবনাথ
বর্ষা মানে ভারী বৃষ্টি ।
নতুন কিছু হবে সৃষ্টি ।।
বর্ষা মানে পূর্ণ ভরসা।
কৃষকের ভালোবাসা ।।
বর্ষা মানে আম-কাঁঠালের গন্ধ।
মালিক-চোরের দ্বন্দ্ব।।
বর্ষা মানে মাঠে কৃষক ।
ভূমি-তলে চলছে ফলক ।।
বর্ষা মানে আষাঢ়-শ্রাবণ ।
কৃষক বন্ধু আশা- প্রবণ ।।
বর্ষা মানে বন-মহোৎসব।
প্রকৃতি পুজোর এই তো উৎসব ।।
বর্ষা মানে গাছ লাগাও ।
পৃথিবীতে প্রাণ বাঁচাও ।।
বর্ষা মানে কাদামাটি ।
মাটির চেয়ে নেই যে খাঁটি ।।
বর্ষা মানে মেঘের খেলা ।
ঘোর অন্ধকার দুপুরবেলা ।।
বর্ষা মানে রৌদ্র-ছায়া ।
কত সুন্দর করবে মায়া।।
বর্ষা মানে বন্যা-প্লাবন ।
ভেসে যায় কতো যে ধন ।।
বর্ষা মানে আনন্দ-ধারা ।
মৎস জাতি পায় যে ছাড়া ।।
বর্ষা মানে সৃষ্টিশীলতা ।
জাগুক প্রাণে মানবতা।।
শিশির অধিকারী
মেঘে ঢাকা মুখ
----- শিশির অধিকারী
আকাশ পানে চেয়ে আছি
অবাক জলপান
নেই রোদ নেই বৃষ্টি
আশায় আশায় দিন গোনা
কি যে হবে হায়
আমার মুখ ঢেকে আছে
কালো মেঘের ছায়ায়।
রাজেশ ভট্টাচার্য্য
বর্ষা সুন্দরী
------রাজেশ ভট্টাচার্য্য
হে সুন্দরী, শুনছো আমার কথা?
হ্যাঁ গো তোমাকেই বলছি,
সবাই তোমাকে রানী বলে ডাকে,
আমি তোমাকে সুন্দরী বললাম,
তাতে আবার রাগ করো না কিন্তু।
আচ্ছা তুমি শরৎবাবুকে চেনো?
উনি এলেই চলে যাও কেনো?
তুমি খুব ভালো গো,
তোমার আগমনে ধরণী হয়ে উঠে সিক্ত,
নদী রূপের বসন পড়ে
মহাকল্লোলে ক্রীড়া করে,
ময়ূর পুচ্ছ তুলে নাচে।
তবে একদিন তোমাকে
খুব ভয় পেয়েছিলাম জানো,
সেদিন আমার মনে হল
তুমি তোমার রূপের জোয়ারে
পুরো পৃথিবীটাকে ভাসিয়ে দেবে।
সেদিন বুঝি তোমার খুব রাগ হয়েছিল?
কেনো রাগ করেছিলে গো?
তোমাকে দেখে মুগ্ধ হই,
যখন তুমি অপরূপ সাজে সাজো।
আর এমন ভাবে রাগ করো না,
তোমাকে আমার মাথার দিব্যি দিলাম।
এতে সদস্যতা:
পোস্টগুলি (Atom)