কবিদের ভাবনায় 'বর্ষা ও বর্ষামঙ্গল'
-------হেমন্ত দেবনাথ
ঋতুরঙ্গমঞ্চে স্বমহিমায় যে ছুটে আসে, সে ''শ্যাম গম্ভীর বরষা"। মেঘের মৃদঙ্গ বেজে উঠে গুরু গুরু রবে। ঝড়ো হাওয়ায় উতলা হয়ে বারিধারা "ঝর ঝর ঝরে"। কখনো মুষলধারে, কখনো রিম্ ঝিম্ নূপুর নিক্বনে। মেঘ মেদুর মায়াবী ছায়ায় আচ্ছাদিত হয় পথ-পার্ক-গাছ-গাছালি ও বনবীথি।
বর্ষা শ্যামাসুন্দরী। তার সজল শ্যামশোভা, বৃষ্টিঝরা মেঘ-কাজল দিনটির মায়াবী শোভা বড়ই অনুপম। বর্ষা যেন অনুপম সৌন্দর্য ও ভয়ংকরের সমন্বয়ী রূপ। তবুও বর্ষা মানুষের মনোজগতে সঞ্চারিত করে আবেগ, নতুন ভাব, উদ্দীপনা ও সৃষ্টিশীল মনোভাব। যুগে যুগে তাই বর্ষার কত অপূর্ব ছবি এঁকেছেন কবি ও শিল্পীরা। বর্ষালগনে কবি মনের অন্তর্লোকের নিবিড় বার্তাটি আমাদের প্রাণবন্ত করে-----" হাজার বৎসর পূর্বে কালিদাস সেই যে আষাঢ়ের প্রথম দিন কে অভ্যর্থনা করেছিলেন এবং প্রকৃতির সেই রাজ্যসভায় বসে অমর ছন্দে মানবের অমর সঙ্গীত গেয়েছিলেন, আমার জীবনেও প্রতি বৎসর সেই আষাঢ়ের প্রথম দিন তার সমস্ত আকাশজোড়া ঐশ্বর্য নিয়ে উদয় হয়।"
"মেঘদূত" কাব্যগ্রন্থে যক্ষের বিরহ বার্তা, যক্ষ-প্রিয়ার বেদনা কালিদাসের লেখনীতে বাঙ্ময় উঠেছে। যক্ষের কাছ থেকে বার্তা নিয়ে মেঘ পৃথিবীর নানা দেশ, প্রকৃতি, নদী পেরিয়ে প্রিয়ার কাছে পৌঁছায়। আর যক্ষ-প্রিয়া অনুভবের আবেশে প্রণয়ী যক্ষের স্পর্শ লাভ করেন। মহাকবি কালিদাস সংস্কৃত ভাষায় লিপিবদ্ধ করেছেন। আর বাঙালির হৃদয়ে কাব্যগ্রন্থ খানার প্রভাব ফেলেছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। কারণ তিনিই ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে "মেঘদূত"- এর ছন্দোবদ্ধ বাংলা অনুবাদ করেছিলেন। বিরহের দৃষ্টিতে বর্ষাকে চিত্রিত করেছিলেন কালিদাস। বাংলা কাব্য সাহিত্যে "মেঘদূত" কাব্য খানার গুরুত্ব অপরিসীম। রবীন্দ্রনাথের কন্ঠে অনুরণিত হয়েছিল :-- ----" বহু যুগের ওপার হতে আষাঢ় এল আমার মনে। কোন্ সে কবির ছন্দ বাজে ঝরঝর বরিষণে।।"
আমাদের দেশের বৈষ্ণব কবিরাও বর্ষার অভূতপূর্ব বর্ণনা করেছেন। শ্রীকৃষ্ণ প্রণয়িনী শ্রীরাধার 'অভিসার' পর্যায় বৈষ্ণব কবির বর্ষা বর্ণনা ফুটে উঠেছে :--
-----" তহি অতি দূরতর বাদল দোল। বারি কি বারই নীল নিচোল।।"
বর্ষায় মেঘমেদুর বিষন্ন দিনগুলোতে হৃদয় মন কেন যে অহেতুক বিয়োগ-বেদনায় হয় অধীর ! বিরহিনী শ্রীরাধার অন্তর্বেদনা রূপ নিয়ে চিরন্তন বিয়োগ-বেদনায় :--
-----" এ সখি হামারি দুঃখের নাহি ওর। এ ভরা-বাদর মাস ভাদর শূন্য মন্দির মোর।"
শুধুমাত্র বৈষ্ণব কবিরাই নন। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, মোহিতলাল মজুমদার, এমনকি বঙ্কিমচন্দ্রও বর্ষার বর্ণনায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন। আকাশে মেঘ কবি নজরুল আপ্লুত হয়ে লিখলেন :-
----- "........ ছিটিয়ে মেঠো জল খেলেন যে অবিচল কাজলা দীঘির জলে ঢেউ তোলে-- আনমনে পদ্ম-পাতার থালিকা।
মেঘের সাথে বিদ্যুতের জলসানি আর কাল আকাশের দিকে চেয়ে নজরুল লেখনি ধরলেন :-
---" খেলে চঞ্চলা বরষা বালিকা মেঘের এলো কেশে ওড়ে পূর্বালি ....................বলাকার মালিকা।"
বর্ষার আবির্ভাবে মানব-মনে বিরহ-বেদনার উদ্রেক হয়, যদি না প্রিয়া কাছে থাকেন। তাই কবি নজরুলের কণ্ঠে শোনা গেল :-
----" যে দেশে যবে বাদল ঝরে কাঁদে না কি প্রাণ একেলা ঘরে, বিরহ
ব্যথা নাহি কি সেথা বাজে না বাঁশি ...................................নদীর তীরে।"
বিশ্ববন্দিত কবি রবীন্দ্রনাথও তার "জীবনস্মৃতি" গ্রন্থ লিখেছিলেন :-
-----" মনে পড়ে শ্রাবণের গভীর রাত্রি, ঘুমের ফাঁকের মধ্যে দিয়ে ঘন বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ মনের ভিতরে সুপ্তির চেয়েও নিবিড়তর একটা পুলক জমাইয়া তুলিতেছে..........।" কবি চেতনে-অবচেতনে স্বপ্নে-জাগরণে যেন বর্ষার পিছু পিছু ছুটেছেন। কত ভাবে, কত রূপে, কত বিচিত্র ভাষায় যে রবীন্দ্রনাথ বর্ষাকে অনুভব করেছেন তা ভাবলে সত্যি আশ্চর্য হয়ে যেতে হয়।
বর্ষার প্রথম আবির্ভাবক্ষণে কবি রবীন্দ্রনাথ বর্ষাকে স্বাগত জানালেন :-
-------" আনো মৃদঙ্গ মুরজ মুরলী মধুরা, বাজাও শঙ্খ হুলুরব করো বধূরা,
এসেছে বরষা, ওগো অনুরাগিনী।"
বৃষ্টির সাথে কবি মনের একাত্মতা তার সংগীত এই ফুটে উঠেছে :-
----" ওরে বৃষ্টিতে মোর ছুটেছে মন, লুটেছে এই ঝড়ে
বুকে ছাপিয়ে তরঙ্গ মোর কাহার পায়ে পড়ে।"
বর্ষার আবির্ভাবে বিরহ-বেদনার উদ্রেগ কবি সঙ্গীতেও ফুটিয়ে তুলেছেন :-
----" এসো শ্যামলও সুন্দর, আনো তব তাপহরা তৃষাহরা সঙ্গসুধা।
বিরহিনী চাহিয়া আছে আকাশে।"
ঝড়ের রাতে চলে কবির প্রেয়সীর অভিসার :-- ---" আজি ঝড়ের রাতে, তোমার অভিসার পরান সখা বন্ধু হে আমার।"
বর্ষার বৃষ্টিধারার কল্যাণময়ী রূপও রবীন্দ্রনাথের কাব্য-গাথায় ফুটে উঠেছে:-
----" তোমার মন্ত্রবলে পাষাণ গলে, ফসল ফলে-
মরু বহে আনে তোমার ফুলের ডালা....।"
কবি মোহিতলাল মজুমদারের কন্ঠে " কালবৈশাখী" কবিতায় শোনলাম:--
---" ওরি মাঝে আছে কাল-পুরুষের সুগভীর পরামর্শ।"
কবি অক্ষয় কুমার বড়াল, কবি জীবনানন্দ দাশ প্রমুখ অনেক কবি বর্ষা নিয়ে লিখেছেন, তুলির টানে শিল্পীর হাতে বর্ষা প্রতিধ্বনিত হয়েছে। বর্ষায় আছে প্রাণের নিবিড় একাত্মতা। বর্ষার শ্যামল-কোমল স্পর্শে মানুষের মনোলোকে হয় সরস, আনন্দে উদ্বেল। মানুষের উৎসবাদির মধ্যে, সংস্কৃতির কর্মধারায়, চিন্তা-চেতনায় তার আনন্দ উদ্দীপনার বহিঃপ্রকাশ। ঐক্যের উৎস ঝুলনোৎসব ও রাখি বন্ধন হয় বর্ষার শ্রাবণী পূর্ণিমায়। বর্ষার বোধনযজ্ঞে আমরা উদ্বেলিত হই, পালন করি 'বর্ষামঙ্গল উৎসব'। বর্ষার মধ্যেই আমরা খুঁজে পাই জীবনের নববিধান। তাপদগ্ধ পৃথিবীর বুকে নেমে আসে নবজীবনের আশীর্বাদের মতন বর্ষা । তাই বর্ষামঙ্গল উৎসবলগ্নে কবিগুরুর কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে আমাদের প্রার্থনা হোক:-
------ "......... হৃদয় বিমল হোক্, প্রাণ সবল হোক্, বিঘ্ন দাও অপসারী। কেন এ হিংসা দ্বেষ, কেন এই ছদ্মবেশ কেন এ মান-অভিমান। বিতর বিতর প্রেম পাষাণ হৃদয় জয় জয় হোক্ তোমারি।"
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন