সাহিত্য নয়নে আপনাকে স্বাগত

"সাহিত্য নয়ন" সাহিত্য পত্রিকায় আপনাকে স্বাগত। ( প্রকাশকের লিখিত অনুমতি ছাড়া এই পত্রিকার কোন অংশ কেউ প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে)

শুক্রবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০২০

শুভময় রায়


                                    সেদিনের ভয়ঙ্কর রাতে

     

                                                                                                                                                                                               --------শুভময় রায়


যেসময়ের গল্প বলছি তা আজ থেকে প্রায় কুড়ি বছর আগের। তখনও আমাদের বর্ধমান জেলার অনেক গ্রামে বিদ্যুৎ আসেনি। আমার মামার বাড়ি দামোদর নদের ধারে বেড়ুগ্রামেও তেমন আধুনিকতার ছোঁয়া আসেনি। তবে ছোটোবেলা থেকে মামারবাড়ি যাবার একটা অন্যতম আকর্ষণ ছিল মামাদাদু। সম্পর্কে উনি মায়ের মেজমামা, তাই আমার মামাদাদু। কোলকাতায় চাকরি করতেন, বিয়ে করেননি, তাই আমার মামারবাড়িতেই চলে আসতেন ছুটি পেলেই।  পরে চাকরি ছেড়ে তো পাকাপাকি ভাবে বেড়ুগ্রামেই রয়ে গেলেন। সারাদিন মামাদের চাষের কাজের তদারকি করতেন। এই দাদুর ছিল অজস্র গল্পের সম্ভার। আমরা মামাতো, মাসতুতো ভাই-বোনেরা দাদুকে ঘিরে থাকতাম। একবার এমনই এক গল্পের আসরে আবদার করলাম,"দাদু, আজ একটা ভুতের গল্প শুনবো।"

দাদু বললো, "তোরা এখনকার ছেলে, ভুতে বিশ্বাস করিস?"

আমি বললাম, "খুব একটা করি না, কিন্তু ভয় একটা লাগে।"

দাদু বলল, "বেশ আজ তবে তোদের আমার নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলব, যা আজও আমার কাছে যেমন ভয়ের, তেমনি বিস্ময়ের।"

দাদুর জবানিতেই গল্পে বলছি।

"তখন আমি অনেক দেরি করেই, প্রায় চার পাঁচ মাস অন্তর বেড়ুগ্রামে আসতাম। তখন বেড়ুগ্রাম ছিল রীতিমতো বন জঙ্গলে ঘেরা, দিনের বেলাতেও শেয়াল ডাকতো।রাতে অবস্থা আরও ভয়ঙ্কর, তার ওপর সাপখোপের ভয় তো ছিলই। সবচেয়ে বেশি অসুবিধা হতো বর্ষাকালে, খেয়া ঘাটে মাঝিদের পাওয়া যেত না সবসময়। এমনি এক বর্ষার সকালে চিঠি পেলাম, বড়দি মানে তোদের দিদুন ডেকে পাঠিয়েছেন পিসিমার শরীর অসুস্থ। পড়িমড়ি করে অফিসে ছুটি নিয়েই বেড়িয়ে পড়লাম। কিন্তু হাওড়া থেকে মেমারি আসতেই সন্ধ্যা হয়ে গেল। জামালপুরে এসে পৌঁছাবার আগেই ঝমঝম করে বৃষ্টি নামলো। আমি তো প্রমাদ গুনলাম।খেয়া ঘাটে কেউ নেই।বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, বৃষ্টি পড়ছে, আমি একা। একটু ঘাবড়ে গেলাম। একটা গাছের নীচে দাঁড়ালাম। ভাবছি এখনও অনেকটা রাস্তা যেতে হবে,আর নৌকা না পেলে বাঁধের এর পাশ দিয়ে শ্মশানের ওপর দিয়ে যেতে হবে। এমনিতে আমি খুবই ডাকাবুকো, ভুত বা অশরীরী আত্মা এসবে ভয় খাই না। কিন্তু রাত বিরেতে একা যাওয়াটাও একটু বিপদের। যদিও সাথে কোনো দামি জিনিস নেই, ব্যাগে পিসিমার পছন্দের একটু সন্দেশ আর পকেটে আছে কিছু টাকা। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে বৃষ্টিটা ছেড়ে এল,আমি তাকিয়ে দেখলাম আশেপাশে কেউ নেই।ব্যাগ থেকে টর্চটা বের করে বাঁধ বরাবর হাঁটতে লাগলাম। এমনিতে এই রাস্তা আমার তো চেনা, কিন্ত সেদিন যেন কেমন হঠাৎ করেই একটা গা ছমছমে ভাব লাগলো। একটা রাতচড়া পাখি ট্যাঁ ট্যাঁ করে দূরে ডেকে উঠলো। বোধহয় অমাবস্যা ছিল, আরও অন্ধকার চারিদিকে। আমি হনহন করে হাঁটছি। প্রায় মিনিট পনেরো হাঁটার পরে হঠাৎ দেখি আমার পাশেই একটা ছাগল 'ম্যা ম্যা' করে ডেকে উঠলো। আন্দাজে ভাবলাম রাত প্রায় ন'টা, এত রাতে নদীর ধারে ছাগল! নির্ঘাত চড়তে এসে বৃষ্টিতে আটকে পড়েছিল।আমি কিছু না বলে হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ ভাবলাম, আচ্ছা নদীর বালিতে ছাগল চড়তে আসবে কেন? তারপর যেই তাকিয়েছি দেখি ছাগল উধাও! একটু থমকে গেলাম, কিন্তু সাহসটা হারালাম না। হাঁটতে লাগলাম  বালির ওপর দিয়ে। কিন্তু এবার কিছুটা গিয়েই দেখি একটা সাদা গরু, মসমস করে ঘাস খাচ্ছে। এবারে  সত্যিই ভয় পেয়ে গেলাম। বালিতে গরুর ঘাস খাবার  তো কথা নয়। আমি কিন্তু থেমে পড়িনি, জানতাম অশরীরী আত্মাকে এগুতে দিলে চলবে না। হঠাৎ গরু চলে গেল, আর একটা সাদা কাপড় উড়তে উড়তে শ্মশানে গিয়ে পড়ল। মনে মনে খুব ভয় পেলেও টর্চটাকে শক্ত করে ধরে মনে মনে মা দুর্গাকে ডেকে এগুতে লাগলাম। জানি ভয় পেয়ে থেমে গেলেই আমার আর নিস্তার নেই। ভাবতে ভাবতে শ্মশানের কাছে আসতেই দেখি বামদিকে বিরাট এক শাল গাছ। এখানে তো শাল গাছ কোনোদিন থাকেনি! তার মানে আমায় সেই আত্মা এখনও পিছু ছাড়েনি।আমার এবার মনে সাহস হারাতে থাকলাম।পাগলের মতো দৌড়াতে লাগলাম, যে করেই হোক আমায় গ্রামে পৌঁছাতে হবে, না হলে আজ আমায় ছাড়বে না এরা।

গ্রামের মুখেতেই একটা আমগাছ ছিল। দৌড়াতে দৌড়াতে সেখানে আসতেই দেখি সাদা কাপড় পরা এক ছায়ামূর্তি আমগাছের ডালে বসে পা দোলাচ্ছে আর বলছে "সন্দেশ না দিয়ে কোথায় যাবি?"

আমার মনে পড়ল পিসিমার জন্য ব্যাগে সন্দেশ আছে।আমি ভয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। পায়ে আমার একটুও শক্তি নেই।আর সেই ছায়ামূর্তি বারবার বলেই চলেছে।

হঠাৎ দেখি মাঝের পাড়ার দীনুকাকা গান গাইতে গাইতে আসছেন ছিপ নিয়ে নদীর দিকে। দীনু কাকার মাছ ধরার নেশা খুব জানি। আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম,"দীনু কাকা! আমায় বাঁচাও।"

দীনু কাকা 'কে' বলেই বললেন "অ সদানন্দ!তা এত রাতে তুমি!আসার কথা ছিল বুঝি!" তারপর দেখি সেই ছায়ামূর্তিকে দেখেই বললেন,"যাঃ!যত্তসব ঘাটের মড়া"।

বলতে বলতে ছায়ামূর্তিও অদৃশ্য হয়ে গেল।

আমি তো অবাক। আমায় কিছু বলতে না দিয়েই তিনি বললেন, "বুঝলে, রাত বিরেতে কত কি হয়!তা তুমি তো বাড়ি যাবে।চলো এগিয়ে দিয়ে আসি তেমাথা অবধি।"

রাস্তায় আসতে আসতে দীনুকাকা অনেক কিছুই বললেন। আমি বললাম,"কাকা, আজ আপনি না এলে বোধহয় মারাই যেতাম।!"

বলতে বলতে তে মাথার মোড়ে আসতেই বললেন, "যাও দিদির বাড়ি চলে যাও, আমি একটু নদীর দিকে যাব।"

দিদির বাড়িতে পৌঁছাতাই দিদি বললেন,"কিরে এত রাত হলো! আমরা ভাবলুম আসবি না আজ।"

আমি এক এক করে সব কথা বলতেই ওরা তো কেমন হয়ে গেল।বড়দির শাশুড়িমা একটু আগুন জ্বেলে বললেন তাপ নিতে আর একটা লোহা ছুঁতে। আমি বললাম,"কেনো?"

বড়দি বললেন, "কি দীনুকাকা বলছিস? দীনুকাকা আজই মারা গেছে সকালে, বিকালে সবাই তাকে নদীতে দাহ করে এল।"

আমি তো শুনে হতবম্ব! এতটা রাস্তা একজন অশরীরীর সাথে গল্প করতে করতে এলাম! আবার সে- ই আমায় বাঁচালো!"

এই বলে মামাদাদু থামলেন। আমরা ভাই বোনেরা চুপ করে শুনছিলাম। সত্যিই আমাদের গায়েও যেন কাঁটা দিয়ে উঠলো দাদুর জীবনের এই ভয়ঙ্কর রাতের কথা শুনে।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন