উদাসী বসন্ত
-----------শান্তশ্রী মজুমদার
শীতবুড়ি সাদা কুয়াশার চাদর সরিয়ে যখন লাঠি হাতে ঠক্ ঠক্ করতে করতে হিমালয়ের দিকে পা বাড়ায় তখন ই কোন এক ভোরে ঘাসের বন থেকে উঁকি দেয় হলুদ, বেগুনী বুনো ফুলেরা। মনু নদীর পাড়ে পাড়ে, শুকিয়ে যাওয়া ঝোপ ঝাড়ে থোকা থোকা নয়নাভিরাম ঘেঁটু ফুলেরা হাসতে শুরু করে। নতুন পাতায় সেজে ওঠা আমগাছের ডালে ডালে প্রস্ফুটিত হয় আম্রমুকুল। আর হঠাৎ করেই প্রকৃতি মুখরিত হয়ে ওঠে কোকিলের কুঁহু ডাকে।
জানিনা বসন্তের কোকিলা এতোদিন কোথায় ঊনকোটির কোন জঙ্গলে অপেক্ষা করছিলো ঋতুরাজের। বসন্তের আগমনের বার্তা নিয়ে সুরেলা কন্ঠে গান গাইতে গাইতে হাজির হয়ে যায় আমার উঠান পাড়ের আমগাছের মগডালে। কখনো সে নীমগাছের ডালে, কখনো কৃষ্ণচূড়ার পাতার আড়ালে, কখনো বা ঝাঁকড়া দেবদারুর সরু ডালে বসে আপন মনে ডাকতে থাকে তার বসন্তের সাথীকে।
আশ্চর্য লাগে, এতো কোকিল থাকে আমাদের কৈলাসহরে! না কি একটি কোকিলা ই পূবের ঊনকোটি থেকে উড়ে বেড়ায় পশ্চিমের কাঁটাতারের বেড়া পর্যন্ত।
চিরহরিৎ অপরূপা জগন্নাথপুর চা বাগিচার ছায়াবৃক্ষের ডালে ডালে যে কোকিলাকে ডাকতে দেখেছি, তাকেই আবার দেখেছি মনুভ্যালীর হালাইছড়ার গহন বাঁশের ঝাড়ে।
আমার ভাবুক মন কোকিলাকে জিজ্ঞেস করে ----
--বনে বনে দেখিস যখন পরের বাসা, ও পাখি /
একটি বারও পরানটা তোর উদাস হয়ে যায় না কি?
মধ্যরাত থেকেই আমগাছের মগডালে বসে কোকিলার সুরেলা মদির ডাক শুরু হয়। সারাটি রাত ধরে সে অবিশ্রান্ত ভাবে ডাকতে থাকে। আমার ঘুমের বারোটা বাজিয়ে বিরহী কোকিলা তার প্রেমিক কোকিলকে আহ্বান করতে থাকে। ভোরের সূর্য পূব আকাশে আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠে তবুও কোকিলার প্রেমিক মেলে না।আমার মননে তখন একটাই সুর বাজতে থাকে ----
ভালোবাসা দেখলি শুধু, ভালোবাসা বুঝলি না।
বুকের মাঝে হারায় যে মন, সে মনটারে খুঁজলি না।
----মনে হয় একটি কোকিলারই সাথী হারিয়ে যায় প্রতি বসন্তে! না কি প্রতি বসন্তে নতুন নতুন সাথী চাই কোকিলার! তাই বোধহয় কুঁহু সুরে উদাত্ত আহ্বান জানাতে থাকে। তার মদির আহ্বান কি পৌঁছায় না সংযমী কোকিলের কানে!
----কি সাধ আজো গোপন আছে, দিব্যি করে বল না আমায় ভাই রে.....।
ফাল্গুন চলে যায়,চৈত্রও চলে যায়..... বৈশাখ এসে যায়। কিন্তু কোকিলার সাথী খোঁজার পালা,ঘর বাঁধার আশা হারিয়ে যায় না। কালবৈশাখীর ঝড় জলের দুপুরেও বৃষ্টিস্নাত সুউচ্চ গাছের মগডালে বসে, পাতার আড়ালে মুখ লুকিয়ে কোকিলা ডেকে চলে আপন মনে। কালবৈশাখীর তাণ্ডবে ভেঙে গুড়িয়ে ছত্রখান হয়ে মাটিতে পড়ে থাকে ঘুঘু, শালিকের বাসা। কোকিলার আপন বাসা নেই, তাইতো সে ভবঘুরে।
------সবারই তো ঘর রয়েছে, কেন রে তোর বাসা কোথাও নাই রে, /কখনো কি মন বলেনা, এমনি বাসা একটি আমি চাই রে /ও কোকিলা তোরে শুধাই রে....।
কৈলাসহরের অঙ্গনে বসন্তকাল, ফুল আর কোকিল যেন প্রকৃতির অপরূপ দান। ছয়টি ঋতুই এখানে নিজের নিজের সৌন্দর্যের ডালা সাজিয়ে হাজির হয়ে যায় নির্দিষ্ট সময়ে। আমাদের মনুর তীরে বসন্তে লাল পলাশের পদচারণা ঘটে না সত্যি,কিন্তু বনে জঙ্গলে অনাদরে ফুটে থাকা ঘেঁটু ফুলেরা সুমিষ্ট সুবাস ছড়িয়ে অপেক্ষা করে পথিকের। হলুদ বরণ কলকি ফুলেরা বসন্ত উত্সব করে গাছে গাছে বাসন্তী হলুদের রঙ মেখে।
ঊনকোটির ছায়ায় বিস্তৃত এই জনপদে বসন্তের রাতে ঝড়ো হাওয়া আর শিলাবৃষ্টি গাজনের নৃত্য শেষে ক্লান্ত হয়ে ফিরে গেলে, ভোরের নরম আলোয় যে শীতল হাওয়া বইতে থাকে তাকেই বলে বোধহয় বসন্ত সমীরণ।
এই আদুরে শীতল হাওয়া মনে করিয়ে দেয় হারিয়ে যাওয়া মায়ের মমতার স্পর্শ কে। ঝিরিঝিরি হাওয়ায় বাগানের লাল জবা গুলো দুলতে থাকে আর বর্ষা স্নাত মাধবীলতারা লাল গোলাপী আভা ছড়াতে থাকে ভোরের সূর্যের কমলা রঙ গায়ে মেখে। দূরের কোন এক গাছে বসে কোকিলার সুরেলা উদাসী ডাক কানে আসলেই মন উদাস হয়ে যায় অজানা শূন্যতায়।
বসন্ত আসে, কোকিল ডাকে, প্রকৃতি সেজে ওঠে ----এই সবকিছুই মনোজগতের চিন্তন মননকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়।কোন জনমের ভালোবাসার অপ্রাপ্তি মথিত করে তোলে বিরহী মনকে।
----------------------------11/04/2021
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন