'লালিত ভীরু' শিশুরাই জেগে উঠবে 'আকাশের ডাকে'
------হেমন্ত দেবনাথ
শুভ্রপ্রাণ শিশুরাই আগামী প্রজন্মের স্বপ্ন ও সম্পদ। এরাই দেশের সুনাগরিক। অথচ পূর্ণবিকশিত হওয়ার আগেই পথ-প্রান্তরে অগণিত শিশু-পুষ্প অকালে ঝরে পড়ে। অতীতকালেও শিশুরা ঘরে-বাইরে সর্বত্র ছিল অনাদৃত। প্রচন্ড মারপিট ও শারীরিক ক্লেশই ছিল অতীতে শিশুদের শিক্ষা ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, ব্যাধি ছিল বেশিরভাগ শিশুদের নিত্য সাথী। এছাড়া কল-কারখানায়ও শিশুদের অমানবিক শ্রমদান করতে হতো অতীতেও।
ইউনেস্কোর মতে, চৌদ্দ বছর বয়সের নিচে ছেলে-মেয়েদের শিশু ও কিশোর বলে গণ্য করা হয়। এই অপরিণত বয়সের গরিব ছেলে-মেয়েরা জীবিকা নির্বাহের তাগিদে ক্ষেতে-খামারে, ঘরের কাজে, দোকানে-রেস্টুরেন্টে, কলকারখানায়, কার্পেট বোনা, হীরে কাটা, চুড়ি তৈরি, তাঁত ও জরির কাজ, দেশলাই-বিড়ি-বাজি-কাগজ তৈরি, কয়লা খনিতে কাজ, ইট ভাটায় কাজ, গালা তৈরি, সাবান তৈরি, রাজমিস্ত্রীর জোগান দেওয়ার কাজ, কাজ ও কীটনাশক ঔষধ তৈরি, চা ও বাগিচার কাজ, অবস্থাপন্ন মালিকের বাড়িতে ঝি-চাকরের কাজ, রেলস্টেশনে মালপত্র বহন------- এরকম নানা পেশায় আমাদের দরিদ্র শিশুদের শ্রম দিয়ে পয়সা রোজগার করতে হয়। অথচ ভারতীয় সংবিধানের ২৪( চব্বিশ) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, "১৪ বছরের নীচে কোনোও শিশুকে কোনোও কারখানা, খনি বা কোনোও বিপদজনক কাজে নিযুক্ত করা যাবে না।" ১৯৮৬ সালে শিশু শ্রমিক প্রতিরোধ সংক্রান্ত আইন রচিত হয়। আবার, ১৯৯৪ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ভারতের শ্রম মন্ত্রক national authority of elimination of child labour সংস্থাটি গঠন করেন। তবুও শিশুশ্রম থেকে আমাদের শিশুকে পুরোপুরি মুক্ত করা যায়নি।
আজও শুধু ভারতেই নয়, সারা পৃথিবীতে শিশু শ্রমিক রয়েছে। এরা কলকারখানায় প্রতিদিন দশ/বারো ঘন্টা কাজ করতে গিয়ে শিশু শ্রমিকরা স্বাভাবিকভাবে রাসায়নিক পদার্থ ও দূষিত পরিবেশে সংস্পর্শে আসে। এর ফলে ফুসফুসের অসুখ, ক্যান্সার, ত্বকের রোগ, যক্ষা, কখনও বা অপুষ্টিজনিত রোগেও শিশুরা ভোগে।
শিশু শ্রমিকের কারণ হিসেবে যেসব বিষয়কে মোটামুটি ভাবে চিহ্নিত করা যায়, সেগুলো হচ্ছে---------
১) শিশুর পিতা- মাতার নিরক্ষরতা ও দরিদ্রতা। অর্থক্লীষ্টতার জন্যই তাঁরা তাঁদের শিশুকে বিদ্যালয়ের না পাঠিয়ে রোজগারের জন্য পাঠিয়ে দেন। ২) শিশুদের কম বেতনে সহজেই বেগার খাটানো যায়। ৩) শিশুরা বয়স্ক শ্রমিকদের মতো প্রতিবাদ করতে পারে না। ৪) ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের সহজে নিয়োগ করা যায়। ৫) কিছু কিছু নেশাগ্রস্ত পিতা-মাতার নেশা দ্রব্য কেনার জন্য যে অর্থ দরকার, তা মেটাতে শিশুকে কাজে পাঠিয়ে দেন।
শিশুদের উক্ত সমস্যার প্রতিবিধানের জন্য নানা উদ্যোগ জরুরী, যা নিম্নে উল্লেখিত হল :---
* ১) শিশু প্রতিভা অন্বেষণে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, খেলাধুলা, ছবি আঁকা ও বক্তব্য প্রতিযোগিতা বর্ষব্যাপী অব্যাহত রাখতে হবে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে। এজন্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও ব্যক্তি বিশেষকেও বেশি করে ভূমিকা নিতে হবে।
* ২) সমাজের প্রতিটি কোণ থেকে দরিদ্র ও লাঞ্ছিত শিশুদের খুঁজে বের করে এনে তাদের ন্যূনতম চাহিদাগুলো পূরণ করতে হবে। দরিদ্র শিশুদের সার্বিক ভাবে সহযোগিতা করতে হবে।
* ৩) নতুন আইন তৈরি করে সেই আইনের বাস্তব প্রয়োগের উদ্যোগ নিতে হবে।
* ৪) সরকারি উদ্যোগে পরিকল্পনা গ্রহণ, দারিদ্র্য বিমোচন, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, এমনকি প্রয়োজনে জাতীয় বাজেটে শিশু কল্যাণের জন্য আরো বেশি অর্থ বরাদ্দ রাখা।
* ৫) সরকারি উদ্যোগে শিশুদের শিক্ষার অধিকারের প্রয়াস ঘটানো, "বিদ্যালয় ছুট" শিশুদের শিক্ষার অঙ্গনে নিয়ে আসতে হবে।
* ৬) শিশুশ্রমিকদের পূনর্বাসনের যথাযথ ব্যবস্থা করা এবং শিশুদের সুস্থ জীবনে প্রতিষ্ঠার কার্যকারী "অ্যাকশন প্ল্যান" গ্রহণ করতে হবে।
* ৭) সভা, আলোচনা চক্রের আয়োজন তৎসঙ্গে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে।
অবশ্য, শিশু শোষণ সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের জন্য সহানুভূতি, সহমর্মিতা অবশ্যই প্রয়োজন। প্রয়োজন বিপুল পরিমাণ অর্থেরও। এব্যাপারে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রাষ্ট্রসঙ্ঘের শিশুদান তহবিল, আরো এগিয়ে এসেছে। দেশীয় পর্যায়ে সরকার অনুমোদিত অর্থ ও বেসরকারি সাহায্য এবং ব্যক্তিগত সাহায্য রয়েছে।
শিশুদের কল্যাণের প্রতি বিশ্বমানবতার প্রেরণা যোগাতে আন্তর্জাতিক স্তরে ও জাতীয় স্তরে উদ্যোগেরও শেষ ছিল না। ১৯৭৯ সাল থেকে প্রতিবছর ১ লা জুলাই তারিখটি সারা পৃথিবীতে "আন্তর্জাতিক শিশু দিবস" হিসাবে উদযাপিত হয়ে আসছে। ১৯৭৯ সালের ১ লা জানুয়ারি--এ দিনটিতে ভারতে" আন্তর্জাতিক শিশু বর্ষ" এরও শুভ সূচনা হয়েছিল। আজকের কোভিড-19 মহাসংকটের সময়েও সারাবিশ্বে স্লোগান হচ্ছে---- "যেকোনো সময় এর থেকে এই মুহূর্তে বেশি করে, শিশুদের শ্রম থেকে বাঁচান।" আজকের শিশু দিবসের শুভক্ষণে এ বিষয়টাও আমাদের মাথায় রাখতে হবে।
১৪ ই নভেম্বর আমাদের ভারতবর্ষে শিশু দিবস হিসেবে প্রতি বছরই উদযাপিত হয়। এর উদ্দেশ্য হল :- শিশুদের নানা সমস্যার প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা ও শিশুকল্যাণে সকলকে উৎসাহিত করা। আমাদের স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু শিশুদের সাথে খুব বেশি মিশতেন। তিনি বলতেন, "শিশুরা বাগানে গোলাপের কুঁড়ির মতো, যা প্রস্ফুটিত হয়ে চারিদিকে সুগন্ধ বিতরণ করে।" তাদের সঠিক পরিচর্যা করা একান্ত জরুরী। শিশুদের কাছে তিনি "চাচা নেহেরু" নামেই পরিচিত ছিলেন। প্রতিবছর তাঁর জন্মদিন অগণিত শিশুদের নিয়ে উৎসবের মেজাজে পালন করেন। তিনি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বিনামূল্যে প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন। আমাদের শিশুদের অপুষ্টিজনিত রোগের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য তিনি বিদ্যালয় ছাত্র-ছাত্রীদের "মিড ডে মিল"-এর ব্যবস্থা করেছিলেন। পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু শিশুদের অকৃত্রিমভাবে ভালোবাসতেন এবং তাঁর এই ভালোবাসার স্মৃতিকে স্মরণ করে রাখার উদ্দেশ্যে তাঁর জন্মদিনকে "শিশু দিবস" হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং পালন করা হয়।
শিশু দিবসের অনুষ্ঠানে প্রতিবছর যে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম, অঙ্কন প্রতিযোগিতা ও প্রদর্শনী হয়ে থাকে, তাতে সমাজের আভিজাত্য অবস্থাপন্ন পরিবারের শিশুরাই অংশগ্রহণ করে। কিন্তু ঐ যে খেটে-খাওয়া শ্রমিক শিশুরা রেস্টুরেন্টেই কাজ করছে, ভাঙ্গা টিন সংগ্রহ করতে ব্যস্ত। প্রকৃতপক্ষে ঐ দরিদ্র শিশুগুলোকে যতদিন পর্যন্ত আমরা শিশু দিবসের অনুষ্ঠানে শামিল করতে না পারবো, ততদিন পর্যন্ত আমাদের শিশু দিবসের অনুষ্ঠান সার্থক হবে না, পরিপূর্ণতা পাবে না। আমরাও সঠিক দিশাতে উপনীত হতে পারবো না। এ ব্যাপারে সমাজের বুদ্ধিজীবী শিক্ষিত মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে।
আজকের শিশুদের নানা সমস্যা, তাদের দারিদ্র্য, শ্রমিক হিসেবে বেগার খাটানো------ এসব থেকে মুক্তির বার্তা দিতে পারে "শিশু দিবস।" শিশু কল্যাণে মানুষকে ব্রতী করার লক্ষ্যেই এ দিবস উদযাপন।
আগামী দিনের শিশুকে সামগ্রিক সমস্যা মুক্ত রাখতে ও তাদের অগ্রগতির লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি উদ্যোগ আমাদের অন্তরে আশার আলো জাগিয়ে তোলে। "এ বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি" --- কবি সুকান্তের এ প্রত্যয় একদিন ফুলে-ফলে সৌরভিত হয়ে উঠবেই। কবি রবীন্দ্রনাথের শিশু তার মাকে নিয়ে মনের দুর্জয় শক্তি ও আনন্দ নিয়ে মুক্তমনে তেপান্তরের মাঠে আবারো পাড়ি দেবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন