সাহিত্য নয়নে আপনাকে স্বাগত

"সাহিত্য নয়ন" সাহিত্য পত্রিকায় আপনাকে স্বাগত। ( প্রকাশকের লিখিত অনুমতি ছাড়া এই পত্রিকার কোন অংশ কেউ প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে)

শনিবার, ১৫ আগস্ট, ২০২০

হেমন্ত দেবনাথ


                                                                                              রাখীবন্ধন ও রবীন্দ্রনাথ
                                                                                                                   -------হেমন্ত দেবনাথ

রাখীবন্ধন উৎসব হচ্ছে আমাদের প্রাণের সম্পদ। রাখী হচ্ছে রঙীন সুতোয় বাঁধা এমন বন্ধন যা স্নেহ-ভালোবাসা-বীরত্বের এবং সংহতি-সম্প্রীতি এক ঐতিহ্যবাহী প্রতীক। এই রঙীন মঙ্গলসূত্রটি ভাই-বোনের হাতে, ভাই ভাইয়ের হাতে, বন্ধু বন্ধুর হাতে, স্ত্রী স্বামীর হাতে, এক সম্প্রদায়ের মানুষ অপর সম্প্রদায়ের মানুষের হাতে রাখী বেঁধে দেয়। একে অপরের শুভকামনায়, সংহতি কামনায় এরা রাখী বেঁধে দেয়।
                 রাখীবন্ধনের মাহাত্ম্য বড়োই অর্থবহ। যেমন:-
*(১) ভারতের মধ্যযুগে শক্তিমান নৃপতি রা বিলাসিতা ও পারস্পরিক ঐক্যহীনতার হেতু দুর্বল রাজ্য গুলোর উপর আক্রমণ করে পরাজিত করে ঐ রাজ্যগুলোর রাজাদের সিংহাসনচ্যুত করে নিতেন। ফলে তৎকালীন নারীদেরকে সতীত্ব ও মর্যাদা হারিয়ে অপমানিত হতে হতো। তাই রাজপুত নারীরা নিজেদের সম্মান বাঁচাতে "জওহর ব্রত''-র মাধ্যমে প্রাণ বিসর্জন দিতেন। গুজরাটের রানী কর্ণাবতী বিপন্ন হয়ে দিল্লির সম্রাট হুমায়ূনকে 'ভাই' বলে সম্বোধন করে তার কাছে রাখী পাঠিয়েছিলেন। সেই রাখী পাওয়া মাত্রই হুমায়ুন ছুটে গিয়ে তাঁকে বিপদ থেকে বাঁচিয়ে তার প্রাণ রক্ষা করেছিলেন।
*(২) আবার শাস্ত্রীয় মতে, শ্রাবণী একাদশীতে যার প্রারম্ভ আর পূর্ণিমা তিথিতে সমাপ্তি-- এরই নাম কৃষ্ণের ঝুলন বাসর। রাধাকৃষ্ণের এই পবিত্র মিলনের সদ্ভাবকে রক্ষাবন্ধন মন্ত্র আবদ্ধ করা হয় এবং পরস্পর পরস্পরের হাতে মঙ্গলের প্রতীক হিসেবে রাখী বেঁধে দেন।
*(৩) আর স্বদেশপ্রেমের দ্যোতনায় রাখী বন্ধন এর মধুর তাৎপর্যকে বহন করে নিয়ে এলেন ১৯০৫ সালে রবীন্দ্রনাথ ও রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী।
            কাজেই রাখী বন্ধন এর ইতিহাস আমাদের দেশে অনেক পুরোনো। আমাদের দেশ দীর্ঘ প্রায় ২৫০ বছর যাবৎ ব্রিটিশ শাসনাধীন ছিল। "Divide and Rule policy" প্রয়োগ তারা আমাদের দেশে শাসন ব্যবস্থা কায়েম করেছিল। বড়োলাট লর্ড কার্জন এই নীতির মাধ্যমে গোটা বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ঐক্য বিনষ্ট করে তাদের দেশপ্রেমে ভাটা আনয়নের তাগিদে বাংলাকে ভাগ করে নেবার সিদ্ধান্ত নিলেন। লর্ড কার্জনের যুক্তি ছিল এত বড়ো প্রদেশের শাসনকার্য সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার সুবিধার্থে তিনি নাকি বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাঁর মতে, প্রশাসনিক সুবিধার্থে প্রদেশের পুনর্গঠন খুবই জরুরী। তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী---(১) পূর্ববঙ্গ ও আসাম নামে একটি নতুন প্রদেশ গঠন। (২) "বঙ্গদেশ" নামক একটি প্রদেশ গঠন-- এখানে যুক্ত হবে বর্ধমান প্রেসিডেন্সি বিভাগ তার সাথে থাকবে ছোটনাগপুর ও বিহার।
                 লর্ড কার্জনের সুপারিশ অনুসারেই ভারত সচিব বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব অনুমোদন করেন। অবশেষে ১৯ জুলাই, ১৯০৫- এ সরকারিভাবে বঙ্গভঙ্গের কথা ঘোষিত হয়। সমগ্রদেশ জুড়ে মিছিল, মিটিং, হরতাল ইত্যাদির মাধ্যমে শুরু হয়ে যায় তীব্র প্রতিবাদ, আন্দোলন। এই বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন আরও তীব্রতর রূপ ধারণ করেছিল নিম্নোক্ত তিনটি সরকারি ষড়যন্ত্রের জন্যেও:-
(I) ইউনিভার্সিটি বিল (1904) :- দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সরকারের আয়ত্তে এনে উচ্চ শিক্ষাকে ব্যয়বহুল করতে উদ্যত হন। উচ্চ শিক্ষা লাভের পথ এরূপ ভাবে বন্ধ করে দেবার অভিসন্ধি দেশবাসী উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন।
(ii) প্রাথমিক শিক্ষা সংক্রান্ত পরিকল্পনা (11 মার্চ, 1904) :- এর পেছনেও দেশকে ভাগ করে দেবার অপপ্রয়াস।
(iii) কার্লাইল সার্ক্যুলার (10 অক্টোবর, 1905):-  এ সার্ক্যুলার মূলে বলা হয়, বঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে কোনো ছাত্র-ছাত্রী যোগদান করা থেকে বিরত না থাকলে অথবা "বন্দেমাতরম্" ধ্বনিও উচ্চারণ করা থেকে বিরত না থাকলে তাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কার করা হবে। এই তিনটি সরকারি ঘোষণা বঙ্গ বিরোধী আন্দোলনকে তীব্র থেকে তীব্রতর আকারে নিয়ে গেল।

                     ছাত্ররা পিকেটিং করে বড়ো বাজারে বিলেতি দ্রব্য বিক্রি বন্ধ করেছে। ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বহিস্কৃত হতে থাকলো। এজন্যে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি গড়ে তোলার প্রস্তাবও গৃহীত হল। এ উদ্দেশ্যে প্রচুর অর্থ সংগৃহীত হতে লাগলো। রবীন্দ্রনাথও বিদ্যালয় স্থাপনের আহ্বান জানালেন। পুলিশি নির্যাতন চলতেই থাকলো।
                    এই প্রেক্ষাপটে বঙ্গের মানুষের ঐক্যকে সুদৃঢ় ও অক্ষয় রাখার উদ্দেশ্যে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী সক্রিয় ভূমিকা পালনে উদ্যত হলেন। তাঁরা দেশের সংহতির প্রতীক হিসেবে "রাখীবন্ধন" উৎসব পালনের আহ্বান জানালেন। মানুষ তাতে সাড়া দিয়েছিলেন। মানুষকে প্রাণিত করার লক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা করলেন সেই গানটি-------
"বাংলার মাটি, বাংলার জল,
 বাংলার বায়ু, বাংলার ফল----
 পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, হে ভগবান"

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (রবীন্দ্রনাথের ভাতুষ্পুত্র) রাখি বন্ধন এর সূচনা প্রসঙ্গে "ঘরোয়া" নামক গ্রন্থে লিখেছেন----- " রওনা হলোম সবাই গঙ্গা স্নানের উদ্দেশ্যে, রাস্তায় দু'ধারে বাড়ির ছাদ থেকে আরম্ভ করে ফুটপাথ অবধি লোক দাঁড়িয়ে গেছে------ মেয়েরা খৈ ছড়াচ্ছে, শাঁক বাজাচ্ছে, মহা ধুমধাম----যেন একটা শোভাযাত্রা........।" সবাই গান গাইতে গাইতে ছুটলেন। স্নান সেরে নেবার পর গঙ্গার ঘাটে একে অপরের হাতে রাখী পরিয়ে দিয়েছিলেন এবং তাঁরাও সেটা সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। বাংলার ঘরে ঘরে পালিত হল অরন্ধন। স্বদেশী দ্রব্য গ্রহণ করতে লাগলেন সবাই আর বিদেশি দ্রব্য বর্জন করতে শুরু করলেন দেশবাসী। আজও রাখীবন্ধন উৎসব প্রাসঙ্গিক। আর দেশের অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষতা চরিত্র বজায় রাখার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথই আমাদের প্রেরণার উৎস। আমরা সেদিন রবীন্দ্রনাথের কন্ঠেই শুনেছিলাম সেই বার্তাটি---------
"সবার পরশে পবিত্র করা তীর্থনীরে,
এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।"

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন