মানবতার যাত্রাপথে------শ্রীচৈতন্যের পদধ্বনি
------- হেমন্ত দেবনাথ
যিনি শুধু ধর্মপ্রচারকই ছিলেন না এবং যিনি হিংসাজীর্ণ স্বার্থপরতামগ্ন, সামাজিক-ধর্মীয় ভ্রষ্টাচারজীর্ণ, অবহেলিত এবং অধঃপতিত শ্রেণীর মানুষের মধ্যে প্রেম ও সাম্যের সেতুবন্ধন করেছিলেন, তিনি হলেন মানবতার পূজারী শ্রীচৈতন্যদেব। তিনি শুধু একটি যুগেরই প্রতিনিধি নন, তিনি যুগের স্রষ্টা। সাহিত্য-শিল্প সংগীত-ভাস্কর্য-স্থাপত্য বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রেও চৈতন্যদেব ছিলেন প্রাণপুরুষ। সেক্ষেত্রেগুলোতেও চৈতন্যদেবের গভীর ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব।
ভারতের নবদ্বীপে ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দে (৮৯২ বঙ্গাব্দে) ফাল্গুনী পূর্ণিমার দিনে চৈতন্যদেবের জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। তার পিতা জগন্নাথ মিশ্র বাংলাদেশের শ্রীহট্ট নিবাসী ছিলেন। তিনি বিদ্যার্জনের উদ্দেশ্যে এসেছিলেন ভারতের নবদ্বীপে, পরে শচীদেবীকে বিয়ে করে নবদ্বীপেই স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেছিলেন। চৈতন্যদেব তার পিতা-মাতার সর্ব কনিষ্ঠ সন্তান। তার ভালো নাম বিশ্বম্ভর, ডাকনাম নিমাই, আর গৌরবর্ণ ছিলেন বলেই সবাই 'গৌরাঙ্গ' বলে ডাকতেন।
মধ্যযুগের বাংলাদেশের ধর্ম, সংস্কৃতি, সাহিত্য, সমাজের উপর শ্রীচৈতন্যদেবের অতুলনীয় প্রভাব ছিল। তাঁর জীবদ্দশার পূর্বে ওপরে বাংলাদেশে অব্যাহত ছিল সামন্তযুগ। তখন ভূ-স্বামীদের শোষণ ও শাসন ছিল কঠোর, আর অস্বীকৃত ছিল মানবতার আদর্শ। তাঁর প্রচারিত ধর্মমত ছিল সে যুগের অনুদার-মতাদর্শের বিরুদ্ধে এক বলিষ্ঠ প্রতিবাদ।
শ্রীচৈতন্যদেব বিপ্লবী ছিলেন না, ছিলেন সমাজ সংস্কারক ও নবযুগের প্রবর্তক। "কৃষ্ণ নামে" তিনি বর্ণভেদ, উচ্চ-নীচ তুলে দিয়ে সামাজিক ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠার প্রাণপন চেষ্টা করেছিলেন। তুর্কি আক্রমণের প্রাবল্যে বাঙালি জাতি হতভম্ব হয়ে পড়েছিল, বিধর্মীদের হাত থেকে হিন্দু ধর্মকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে তদানীন্তন সময়ের ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় শাস্ত্রের কঠোর বিধি-নিষেধ দ্বারা জাতি ও ধর্মকে অচলায়তনে বেঁধে ফেলেছিল। এর ফলে জীবনের স্বাভাবিক গতিধারা ক্ষুদ্র আচার-বিচার-সংস্কারের মাধ্যমে গতিরুদ্ধ হয়ে পড়লো। তখন এই পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে শ্রীচৈতন্যদেব জাতি ও ধর্মকে এই গতিরুদ্ধতা থেকে মুক্তি দিলেন, বৈষ্ণব ধর্মের দুর্বার স্রোতে ভাসিয়ে দিলেন। তিনি বিচ্ছিন্ন জাতিগোষ্ঠীকে জানালেন যে হরিভক্তির ফলে চন্দ্রালে "ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ"হতে পারে। আহ্বান জানালেন---"কোল দাও---আদ্বিজ চন্ডালে।" তিনি জন্মগত বর্ণভেদ প্রথা অস্বীকার করলেন।
শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাবের ফলে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে একটি নতুন শাখার উদ্ভব হয়েছিল এবং সেটি হল 'জীবনীসাহিত্যের শাখা।' চৈতন্যদেবের জীবন কাহিনীকে কেন্দ্র করে বিদ্যাপতি, জ্ঞানদাস, গোবিন্দ দাস, কৃষ্ণদাস কবিরাজ, বৃন্দাবন দাস প্রমুখ বৈষ্ণব কবিগণ কাব্য রচনা করেছিলেন। সে যুগের ধর্ম, সমাজ ও জীবনের কথা এসব কাব্যধারায় বিকশিত হয়েছিল। গৌরচন্দ্রিকা, ব্রজবুলি ভাষা, নীতিবোধ ও রুচিবোধ, সংস্কৃতির প্রভাব, মানবতার উৎকর্ষ সাধন, রাগানুগা ভক্তি, চৈতন্য জীবনাদর্শের যাদুস্পর্শে রসসিক্ত হয়ে উঠেছিল।
শ্রীচৈতন্যদেবের পরোক্ষ প্রভাবেই একটি শিল্প সুষমামণ্ডিত ভাষায় সৃষ্টি হয়েছিল, যা মূলত বাংলা, হিন্দি ও মৈথিলী ভাষার সংমিশ্রণে সৃষ্টি হয়েছিল। সেই ভাষাটির নাম 'ব্রজবুলি ভাষা।' চৈতন্যদেব বৈষ্ণব ধর্মকে কেন্দ্র করে যে আধ্যাত্মবাদ ও জীবনাবেগ সৃষ্টি করেছিলেন, তার ফলেই বৈষ্ণব কবিদের হস্তস্পর্শে ভাষা সূক্ষ্ম অনুভুতি প্রকাশের উপযুক্ত হয়ে উঠেছিল।
প্রাক্- চৈতন্যযুগে রচিত রাধাকৃষ্ণের লীলাবিষয়ক কাব্যে নীতিবোধ ও রুচির স্থূলতা দেখা যায়, চৈতন্য পরবর্তী বৈষ্ণব সাহিত্যে তা বর্জিত হয়েছে। চৈতন্যদেবের জীবনাদর্শে বাংলাসাহিত্যেও রুচি ও নীতিবোধের সার্বিক উৎকর্ষ সাধিত হয়েছিল। চৈতন্যদেবের সুদূর প্রসারী প্রভাবে ছন্দের কারুকার্যে এবং অলংকরণের সৌকর্ষে বাংলা বৈষ্ণবসাহিত্য সঞ্জীবিত হয়ে উঠেছিল।
১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে মাত্র আটচল্লিশ বছর বয়সে পুরীতে শ্রীচৈতন্যদেবের তিরোধান ঘটে। চৈতন্যদেবের তিরোধানের পরেই বাংলা সাহিত্যে গড়ে উঠেছিল চৈতন্য জীবনী সাহিত্য-----যা সত্যিকার অর্থে মধ্যযুগীয় বাংলা কাব্যে অভিনবত্ব সৃষ্টি করেছিল। অবশ্য পরবর্তী সময়ে অদ্বৈত আচার্য, নিত্যানন্দ আচার্য প্রমূখ অন্যান্য বৈষ্ণব গণের জীবনকে নিয়েও জীবনীসাহিত্য গড়ে উঠেছিল। সাধারণতঃ শ্রীচৈতন্যের পূর্বে কোন মর্ত্যমানবকে নিয়ে বাংলা সাহিত্যে এরকম জীবনীকাব্য রচিত হতে দেখা যায়নি।
চন্ডীমঙ্গল ও মনসামঙ্গল শাক্ত কবিগন তাদের রচনায় শ্রীচৈতন্যদেব ও তাঁদের পার্ষদদের বন্দনা করেছেন। এতে প্রমাণিত হয় যে, বৈষ্ণবসাহিত্যের সীমানা পেরিয়ে অন্যান্য বাংলা কাব্যেও চৈতন্যদেবের প্রভাব বিশেষভাবে পরিস্ফুট হয়েছিল। শুধু তাই নয়, মধ্যযুগীয় সীমানা অতিক্রম করে উনিশ শতকের নাটক, যাত্রাগান ও পাঁচালীসাহিত্যেও শ্রীচৈতন্যের জীবনাদর্শ ও ভক্তির আদর্শ প্রতীয়মান হয়েছে। এসব কিছুই মূলত বাংলাদেশে শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাবের প্রভাব।
চৈতন্যদেব সংকীর্ণ ভেদবুদ্ধি সম্পন্ন ধর্মকে উদার ও কুলষতামুক্ত করে প্রাণবন্ত করে তুলেছিলেন। তথ্যের চেয়ে হৃদ্ শক্তিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল ধর্মচর্চায়, তাতে ধর্ম-উপাসনা অনাড়ম্বর ও সরল হয়ে উঠেছিল। চৈতন্যদেব সাম্যবাদী আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন। তাঁর মতে চন্ডাল, মুচি, মেথর, যবন সবাই এক সূত্রে গ্রথিত হতে পারে, যদি তারা কৃষ্ণপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়। তাঁর মতে, মানুষের সৎ আচরণ ও আদর্শই তাকে মহীয়ান করে তোলে, তার জন্ম যেখানেই হোক না কেন। তিনি প্রথাগত বর্ণভেদ ও জাতিভেদ প্রথার বিরোধী ছিলেন। বৈষ্ণব পদকর্তাগণ প্রেমের সাহায্যে (মধুররস) অর্থাৎ 'রাগানুগা ভক্তি'-র স্বতোৎসারিত স্ফুরণ ঘটিয়ে ঈশ্বর লাভের চেষ্টা করেছেন, যা কোনোও তত্ব বা দর্শনের আঁধারে প্রতিষ্ঠিত নয়। শ্রীচৈতন্যদেব তাঁর আদর্শ ও ধর্মমতকে জীবনানুশীলনের মধ্য দিয়ে প্রতিবিম্বিত করেছেন।
তত্ত্বের সাথে জীবনের যোগ করতে চেয়েছিলেন শ্রীচৈতন্যদেব। তাঁর মতে চর্চার সাথে চর্যার সমন্বয়সাধনই ভারতীয় ধর্মসাধনার লক্ষ হওয়া উচিত। ধর্মসাধনাকে জীবনচর্চায় প্রতিফলিত করা উচিত। নিজে আচরণ করে অন্যকে শিক্ষা দিতে হবে, আচরণের জন্য অনুপ্রাণিত করতে হবে। চৈতন্যদেব মর্ত্যমানবকে তা শিখিয়ে গেছেন। নিজের জীবনে ধর্মকে মূর্ত্যরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছেন শ্রীচৈতন্যদেব। তাঁর মতে, ধর্ম শুধু আচার-অনুষ্ঠানের ধর্ম নয়, ধর্ম হল অন্তরের শাশ্বত ধর্ম। মানুষের পবিত্রতায়, কান্ত রূপে মানুষের মধ্যেই ভগবানের অধিষ্ঠান। প্রেমের মূর্তরূপে তিনি ভক্তের কাছে ধরা দেন। ভগবান কেবল বৈকুন্ঠেরই অধিপতি নন, তিনি পরম সচ্চিদানন্দ মাত্র। শ্রী চৈতন্যের আবির্ভাবের ফলেই এই ভক্তি ভাবনা মানুষের মনে সঞ্জীবিত হয়েছিল।
ঈশ্বরপ্রেমের মধ্যে তিনি মানবপ্রেমের মহতী বাণী প্রচার করেছিলেন। সাহিত্যে দেববাদের পরিবর্তে মানবতাবাদের সূচনা হয়। তাঁর দৃঢ় প্রতিবাদী চরিত্র যে এদেশে প্রথম শাসকের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ------ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তিনি ভারতীয় ভাবাদর্শের মূর্ত প্রতিনিধি। আজকের এই মৌলবাদ, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, বিচ্ছিন্নতাবাদের যুগে নিজ নিজ কর্তব্য কর্মে অবিচল থেকে ভবিষ্যতের মুখী মানবসমাজকে গড়ে তোলার লক্ষে শ্রীচৈতন্যদেবের মানবপ্রেমের বাণী ও আদর্শ, তাঁর নামকীর্তনের নৃত্যতরঙ্গরত পদধ্বনি, চৈতন্য যুগের সাহিত্যসৃষ্টি ধারাকে, সংস্কৃতিকে স্মরণ রাখা একান্ত কর্তব্য। পাশ্চাত্য অপসংস্কৃতির বেলেল্লাপনার বিরুদ্ধে শ্রীচৈতন্যদেবের আদর্শ এক বলিষ্ঠ ও সুদৃঢ় ও প্রতিবাদ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন