সাহিত্য নয়নে আপনাকে স্বাগত

"সাহিত্য নয়ন" সাহিত্য পত্রিকায় আপনাকে স্বাগত। ( প্রকাশকের লিখিত অনুমতি ছাড়া এই পত্রিকার কোন অংশ কেউ প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে)

মঙ্গলবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২০

মলাট (ষষ্ঠ সংখ্যা)


 

সূচিপত্র


 

সম্পাদকীয়

          প্রিয় পাঠক, আজ মনটা বড্ড ভারাক্রান্ত। কখনো প্রিয় জনের অকাল চিরনিদ্রায় শায়িত হওয়া  কখনো বা প্রিয়জনের প্রিয়জনকে হারানোর আঘাত সইতে সইতে আজ বড্ড ক্লান্ত। সম্পাদকীয় লিখতে বসেছি দু-দুবার, কিন্তু লেখনী কথা বলতে চাইছে না। হঠাৎ চোখে পড়ল প্রিয় কবি কিশোর কুমার ভট্টাচার্যের বার্তা -------- "মেঘহীন শারদ আকাশের পূর্ব দিগন্তে বিকেলের পড়ন্ত বেলায় রামধনু দর্শন সত্যি অভাবনীয়। প্রকৃতির লীলাভূমিতে এখনো মেঘবালিকারা ছুটছে তাই তো তাদেরকে সাত রং-এ সাজাতে প্রয়াস ব্যর্থ হবে না"। মনে পড়ল প্রিয় কবি অমল কুমার মাজির কিছু কথা--------"আমার প্রাণের সাহিত্য নয়ন, আমার ভালোবাসার সাহিত্য নয়ন"। চোখে পড়ল রামধনু সংখ্যার পূর্ণতা লাভের পক্ষে যথার্থ কবি ও প্রচ্ছদ শিল্পী কবিতা সরকারের অংকিত প্রচ্ছদ খানি। চোখের সামনে ভেসে উঠলো সাহিত্য নয়নকে সাজাতে সম্মানিত কবি-লেখকদের রঙিন সৃষ্টি। তাতেই শক্তির যোগান পেল ক্লান্ত মন। সকলের সার্বিক সহযোগিতা এবং উষ্ণ অভ্যর্থনায় অভিভূত হয়ে আপনাদের ভালোবাসার টানে অনেক আশা এবং স্বপ্ন জড়িত আরও একটি নতুন সংখ্যা নিয়ে হাজির হলাম। সাহিত্য-সমুদ্রে যাত্রাপথে ষড়ঋতুর তিনটি ঋতুকে স্পর্শ করে এবারে প্রকাশিত হলো "সাহিত্য নয়ন"-এর "রামধনু" নামক ষষ্ঠতম সংখ্যা।  সূর্যের রশ্মি থেকে রামধনুর সাতটি রং আমাদের পরিবেশ ও মনকে প্রভাবিত করে। সূর্যের আলোয় মিশে থাকা সমস্ত রঙে নানা গাছ-পালা,  জীবসকল বেঁচে থাকে এবং সকল রঙের সমন্বয় মানুষকে সুস্থ, সবল, যশস্বী ও গৌরবান্বিত করে। এই সাত রঙের আলোকে আমাদের বাসগ্রহ থেকে কালো যবনিকা হোক ছিন্ন। চলুন আমরা সকলে মিলে তরী ভাসাই সাহিত্যের মহাসমুদ্রে। বাকি কথা হবে আগামী সুস্থ প্রভাতে।


 ধন্যবাদ, শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধা সহ------- 

রাজেশ ভট্টাচার্য্য 

সম্পাদক, সাহিত্য নয়ন

কবিতা সরকার


 

    সত্যি কিংবা কল্পনাতে 

                      ----- কবিতা সরকার



যেতে চাই অনেক দূরে 

সত্যি কিংবা কল্পনাতে 

কোনো এক সুদূর দেশে বরফ ঢাকা পাহাড় পরে 

যেথায় রাঙা সূর্য ওঠে সকল প্রাতে খিলখিলিয়ে । 

ঢেউ হয়ে ফিরবো আমি, অফুরান সেই নদীর বুকে

কিংবা কোনো শীতের ভোরে 

যখন হিমেল হাওয়া লাগবে গায়ে

সেথায় আমি থাকবো জেনো 

ইচ্ছে করেই চুপটি করে । 



যেতে চাই অনেক দূরে 

সত্যি কিংবা কল্পনাতে 

তেপান্তরের মাঠের পরে 

যেথায় মেঘ মিশেছে মাটির সাথে, 

মরিচীকার আলিঙ্গনে । 

থাকবো আমি দিনের শেষে 

নিকেল হওয়া সন্ধ্যা রঙে, 

কিংবা সেই তালের গাছে 

যে বাবুইটা বাঁধছে বাসা 

আনন্দেতে দিনে - রাতে 

সেথায় আমি থাকবো জেনো 

তারই ঠোঁটে ব্যস্ত ভারী কর্মী হয়ে ।



যেতে চাই অনেক দূরে 

সত্যি কিংবা কল্পনাতে 

সব ছাড়িয়ে সেই আকাশ পরে

যেথায় মেঘ ভাসছে নৌকা হয়ে, 

থাকবো আমি চাঁদের দেশে 

চরকা কাটা সেই বুড়ির পাশে, 

কিংবা কভু জ্যোৎস্না রূপে 

পরবো ঝরে আঁধার রাতে 

সেথায় আমি থাকবো জেনো 

শুধুই তোমায় আলো দিতে । 



থাকবো আমি রামধনুর সেই 

রঙ ছড়ানো সাতটি রঙে, 

থাকবো আমি বৃষ্টি ফোঁটায় 

ঝড়বে যা মুক্তো হয়ে, 

থাকবো আমি সেই আলোতে 

যা পথ দেখাবে অন্ধকারে, 

থাকবো আমি শুষ্ক পাতায় 

যা পড়বে ঝড়ে মাটির বুকে, 

থাকবো আমি সুপ্ত বীজে 

যেথায় বৃক্ষ শিশু ঘুমিয়ে থাকে, 

থাকবো আমি লক্ষ-কোটি - যোজন দূরে 

টিমটিম সেই তারা হয়ে ।

কিশোর কুমার ভট্টাচার্য


 

        ফেরিওয়ালা

                    -------কিশোর কুমার ভট্টাচার্য


হরেকমাল দু' টাকা ----

হাঁকে না আজ কোনো ফেরিওয়ালা ; আগে

তো মাথায় ছিলো বিরাট  বোঝা

চলার পথটি ছিল না সোজা।

পথ ছিল পায়ে হাঁটা

মেঠো পথে বিঁধতো কাঁটা। 

এখন কেউ জোরে  হাঁকে না

শুধু বলে,  হ্যালো! 

আপনার একটা পার্সেল 

বেশ! এ পর্যন্তই কথা

নির্দিষ্ট ঠিকানায় চলে আসে পার্সেল 

ওর পিঠে  বিরাট বোঝা 

বাহন মোটর সাইকেল

সে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে জব করে----

সময়ের বিবর্তনে ঐ দিনের ফেরিওয়ালা 

আজ গাঁয়ের পথে পথে হাঁকে না,

সে বিলুপ্তপ্রায় হলেও 

সংসার নাট্যশালায় 

মোদের ফেরি---

বোঝা বয়ে চলা --- চিরজীবী। 


রচনাকাল:- ০৯-০৬--২০২০, মঙ্গলবার।


অমল কুমার মাজি


 

            আগুন    

               -----অমল কুমার মাজি


দুই চোখে আর জল ঝরে না

জ্বলছে আগুন !                   

রৌদ্র -প্রখর তপ্ত দুপুর  

রুদ্রবীণায়...........                       

বাজিয়ে দীপক দিক স'রিয়ে

প্রেমের ফাগুন !            

কালাপাহাড় উঠুক জেগে          

কঠিন ঘৃণায় !                             

পরশুরাম কুঠার হাতে               

আসুক নেমে........                     

দিক গুঁড়িয়ে কুচক্রীদের             

বারুদখানা                              

ভয় পেয়ে আজ কংস রাজা       

উঠুক ঘেমে                                  

বজ্ররোষে শকুন গুলোর ভাঙুক ডানা !                       

বাহুবলীর আস্ফালন আর        

মিথ্যা ভাষণ                                

শেষ হ'য়ে যাক মুক্তি পাক আজ জন্মভুমি.......                 

দাও জ্বালিয়ে দুঃশাসনের      

লোভের আসন                            

পণ করো আজ দেশমাতারই    

চরণ চুমি !!!!


জ্যোতির্ময় রায়


 


           বিদ্যাসাগর ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

                                   --------জ্যোতির্ময় রায়


     বিদ্যার সাগরই বটে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। যদিও উপাধিপ্রাপ্ত প্রথম বিদ্যাসাগর হলেন শ্রীচৈতন্যদেব। প্রাক্ ব্রিটিশ পযার্য়ে বিদ্যাসাগর ছিলেন তিনিই। পরবর্তী সময়ে বিদ্যাসাগর উপাধিপ্রাপ্ত পণ্ডিতরা হলেন মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, মদনমোহন তর্কালঙ্কার, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী প্রমুখ। বিদ্যাসাগর পূর্ববর্তী ছিলেন মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার। পরপর এতজন পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব বিদ্যাসাগর উপাধি অর্জন করলেও সাহিত্যসমাজে বা বাঙালি জীবনে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়েরই বিদ্যাসাগর বলে বহুল মান্যতা রয়েছে। ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধিটাই ইশ্বরচন্দ্র-এর পৈতৃক উপাধি বন্দ্যোপাধ্যায় এর স্থলে স্থায়ী স্থান লাভ করে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নামে জনমনে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।  প্রকৃত অর্থে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাঙালি জীবনে একজন যথার্থ প্রাতঃস্মরণীয় মণীষী।

      ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবনের সাধনায় ছিল দেশে মুক্তমতি নতুন মানুষ তৈরী করা এবং তারই শিক্ষার প্রসারকে তিনি তাঁর জীবনের অন্যতম প্রধান কাজ বলে বেছে নিয়েছিলেন। প্রায় ১৭৫ বছর আাগ বারানসীর সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ ড. ব্যালেন্টাইনের মন্তব্যের উত্তরে বিদ্যাসাগর লিখেছিলেন - “প্রয়োজন বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষার। শাস্ত্রে যাদের অন্ধ বিশ্বাস তাঁরা কখনও এই শিক্ষা দিতে পারবেন না। ..... লজ্জায় আমার মাথা নত করে বলতে হচ্ছে যে ভারতের ধর্মান্ধ পণ্ডিতেরাও মনে করেন যে প্রাচীন ঋষিরা যে শাস্ত্র রচনা করেছেন, তা একেবারে অভ্রান্ত। পরীক্ষা-নীরিক্ষার ভিত্তিতে বৈজ্ঞানিক সত্যানুসন্ধান তাঁদের চরিত্রবিরোধী” --- (বিদ্যাসাগরের চিঠি, বিদ্যাসাগর রচনা সংগ্রহ, প্রথম খণ্ড : পরিশিষ্ট) আজ একবিংশ শতাব্দিতেও বিদ্যাসাগর যে যথার্থ তার প্রমান মিলছে।

    ২০২০ ইংরাজীতেও করোনা সংক্রমন রোধে লাইন ধরে গোমূত্র পান করানোর মতো পশ্চাদ্গামীতার বার্তা সজীব। কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ও বন্ধনশীলতার সমালোচনায় বিদ্যাসাগর প্রায় দুই শতাব্দি আগেও সরব ছিলেন। বিজ্ঞানসম্মত নীতির ভিত্তিতে নতুন শিক্ষা ব্যবস্থার রূপরেখাটির স্পষ্ট ইঙ্গিতও তিনি করেছিলেন :-

ক) বাংলাদেশের শিক্ষা পরিচালনার ভার যাঁরা নিয়েছেন তাঁদের প্রথম লক্ষ হওয়া উচিত সমৃদ্ধ ও উন্নত বাংলা সাহিত্য সৃষ্টি করা।

খ) যাঁরা মূল ইউরোপীয় জ্ঞানভাণ্ডার থেকে শিক্ষালাভের উপকরণগুলি সংগ্রহ করতে অক্ষম, এবং যাঁরা সেই জ্ঞানরাজি সহজ ও উপযুক্ত বাংলা ভাষায় প্রকাশ করতেও অক্ষম, তাঁরা কখনই এই ধরণের সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারবেন না।

গ) মনুস্মৃতি, মিতাক্ষরা দায়ভাগ প্রভৃতি নিশ্চয় পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত থাকবে, যাতে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা সম্বন্ধে ছাত্রদের জ্ঞান সম্পূর্ণ হয়।

ঘ) গণিত, বীজগণিত নিশ্চয় পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভূক্ত থাকবে, তবে তা সংস্কৃত ভাষার মাধ্যমে না পড়ে ইংরাজী ভাষারমা মাধ্যমে পড়াই শ্রেয়।

ঙ) বাংলাভাষায় পাশ্চাত্য সংস্কৃতির ভাবধারা যথাযোগ্যভাবে প্রকাশ করতে হলে বাংলায় বৈজ্ঞানিক পরিভাষা সৃষ্টি করতে হবে ও পণ্ডিতদের তা আয়ত্ত করতে হবে।

চ) প্রতীচ্য ও প্রাচ্যের সমস্ত মতের দর্শনই ছাত্রদের পড়ানোর ব্যবস্থা রাখতে হবে, যাতে বিভিন্ন মতবাদের স্বপক্ষে ও বিপক্ষে নানান যুক্তি-তর্ক পড়ে, ছাত্রদের নিজস্ব স্বাধীন মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠতে পারে। (বিদ্যাসাগর : “নোটস অব সংস্কৃত কলেজ”, বিদ্যাসাগর রচনা সংগ্রহ, প্রথম খণ্ড)।

সমাজসভ্যতাকে এগিয়ে নিতে শিক্ষাকে সার্বজনীন বোধগম্য ও যুক্তিবাদী বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে বিদ্যাসাগরের কথাগুলির প্রাসঙ্গিকতা কালোত্তীর্ণ নয় কি ? সংস্কৃত ভাষার পণ্ডিত হয়ে তিনি উপলব্ধি করেন বাংলা প্রদেশে বাংলাভাষার গুরুত্ব। বাংলার গভর্নর হ্যালিডের কাছে স্কুল-শিক্ষানীতি সম্বন্ধে বিদ্যাসাগর এক প্রস্তাবনা দিলেন। সালটা ১৮৫৪। প্রস্তাবনার ১১ নং অনুচ্ছেদে তিনি লিখেন :

“১) সমগ্র স্কুলে শিক্ষাদান ও শিক্ষাব্যবস্থা বাংলাভাষায় হওয়াই একান্ত জরুরী, কেননা একমাত্র তার সাহায্যেই জনসাধারণের শ্রীবৃদ্ধি সম্ভব।

২) ভাষা ও গণিত শিক্ষার মধ্যে এ পাঠ্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। শিক্ষা সম্পূর্ণ করার জন্য ভূগোল, ইতিহাস, জীবনচরিত,  গণিত, জ্যামিতি, বীজগণিত, পদার্থবিজ্ঞান, শরীরতত্ত্ব, নীতিবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান ছাত্রদের শেখানো অবশ্য প্রয়োজন”।

    আজ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বাংলাভাষী স্কুল তুলে দেওয়া হচ্ছে। বাংলা মাধ্যম তুলে দেওয়া হচ্ছে। বিজ্ঞান বিষয়ের স্কুল সংখ্যা হ্রাস করা হচ্ছে। বিজ্ঞান বিমুখতার দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে প্রজন্মকে। এমনকি বিদ্যালয়ের সংখ্যাও কমিয়ে শিক্ষার সুযোগকে সংকোচিত করা হচ্ছে। অথচ ১৮৫৪ সালে বিদ্যাসাগরকে যখন সহকারী বিদ্যালয় পরিদর্শকের পদাসীন করা হয় তখন তিনি মাত্র চার বছর কার্যকালের মধ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় ২০টি মডেল স্কুল ও মেয়েদের জন্য আরো ৩৫টি স্কুল স্থাপন করেন। মেয়েদের উচ্চশিক্ষার জন্য বেথুন সাহেবের সহায়তা নিয়ে কলকাতায় একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। যার বর্তমান নাম বেথুন কলেজ। এভাবেই তিনি স্ত্রী শিক্ষার চারাগাছটিকে লালন করে গেছেন। অজ্ঞতা ও অশিক্ষার আব্রু থেকে জ্ঞানের আলোকের দিকে বের করে আনার পথ প্রদর্শক বিদ্যাসাগর।

    মেয়েদের প্রতি অপরিসীম মমত্ব ছিল তাঁর। সমস্ত রকম অমানবিক, অনৈতিক দেশীয় আচার প্রথার দৃঢ় বিরোধীতা ছিল তাঁর চরিত্রের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট। ধর্মীয় ভেদাভেদ বা জাতপাত তিনি কখনোই মানতেন না। উচ্চবংশীয় ব্রাহ্মণসন্তান হয়েও তিনি কলেরা রোগাক্রান্ত এক মেথর মহিলার সেবা করে সুস্থ করে তোলেন। কত মুসলমান শিশুকেও তিনি নিজ কোলে বসিয়ে আদর আহ্লাদ করেছেন। বিশেষত: বর্ধমানে বসবাসকালে তাঁর এ ছবিগুলি অনেকেই প্রত্যক্ষ করেছেন। কার্মাটরে দরিদ্র অসহায় আদিবাসী মহিলা ও পুরুষদেরে তিনি নিজ হাতে খাদ্য বিতরণ করেছেন।

      তিনি যা ভাবতেন তা বলতেন এবং যা বলতেন তা করে দেখাতেন। তখনকার সময়ে ছেলেমেয়েদের পড়ার জন্য বাংলাভাষায় কোন বই ছিল না। বিদ্যাসাগর এ নিয়ে কাজ শুরু করলেন। বর্ণপরিচয়, বোধোদয়,, কথামালা, আখ্যানমঞ্জরী, বেতালপঞ্চবিংশতি রচনা করে বাংলা ভাষার নতুন যুগ সূচনা করলেন। ঐ সময়ের শিশু রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী সময়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়েন ঐ রচনাগুলি নিয়ে। মেয়েদের উচ্চশিক্ষার জন্য বিদ্যাসাগর অনেকগুলি কলেজ বেসরকারি উদ্যোগে করে গেছেন। শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর ‘আত্মচরিত’-এ লিখেছেন ‘উনবিংশ শতাব্দির শেষভাগে বঙ্গদেশে বেসরকারি উদ্যোগে যে সমস্ত কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাদের সকলেরই ধ্রুবতারা ছিল বিদ্যাসাগরের মেট্রপলিটান কলেজ।” ১৮৭৩ সালে বিদ্যাসাগর ঐ মেট্রপলিটান কলেজেটি প্রতিষ্ঠা করেন। যার বর্তমান নাম বিদ্যাসাগর কলেজ।

    কথায় ও কাজে, বিঘোষিত আদর্শ ও ব্যক্তিগত আচরণে, সমাজ-জীবনে ও ব্যক্তিগত জীবনে এমন সঙ্গতিপূর্ণ আচরণ ভারত বাংলার নবজাগরণের পতাকাবাহী আর কোন মণীষীর চরিত্রে মেলা ভার। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখায় যথার্থই পাই - “আমরা আরম্ভ করি শেষ করি না, আড়ম্বর করি কাজ করি না, যাহা অনুষ্ঠান করি তাহা বিশ্বাস করি না, যাহা বিশ্বাস করি তাহা পালন করি না, ভুরি-পরিমান বাক্যরচনা করিতে পারি, তিল-পরিমান আত্মত্যাগ করিতে পারিনা, আমরা সকল কাজেই পরের প্রত্যাশা করি অথচ পরের ত্রুটি লইয়া আকাশ বিদীর্ণ করিতে থাকি .... বিদ্যাসাগর সব বিষয়েই ইহার বিপরীত ছিলেন। .... দয়া নহে, বিদ্যা নহে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর চরিত্রে প্রধান গৌরব তাঁহার অজেয় পৌরুষ, তাঁহার অক্ষয় মনুষ্যত্ব।”

      আমাদের বাংলা ভাষা বাংলা বর্ণ এগুলো বিস্তারের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর ভূমিকা খুব বেশি। বিদ্যাসাগর পাণিনি রচিত অষ্টাধ্যায়ী সংস্কৃত ব্যাকরণের সুললিত বাংলাভাষায় অনুবাদ করে বাঙালিদের মধ্যে ব্রিটিশ পরবর্তী সময়ে সংস্কৃতচর্চার পথ করে দেন। একটা সময় নবদ্বীপকে সংস্কৃত চর্চার অক্সফোর্ড বলা হত। এতো এতো পণ্ডিত ছিলেন সেখানে। বিদ্যাসাগরের একটি সংস্কৃত ছাপাখানা ছিল। এই ছাপাখানা নিয়ে তাঁর ভাই শম্ভুচন্দ্র ন্যায়রত্নের সাথে এক সময় মামলা হয়। বিদ্যাসাগর এতে জয়ীও হন। এরপরও ভাইয়ের স্ত্রীর কাছ মাসোহারা পাঠাতেন। যাক এটা তাঁর পারিবারিক বিষয়।

    ব্যাকরণে বাংলা অনুবাদ চালু করায় ব্রাহ্মণ অব্রাহ্মণ নির্বিশেষে স্কুলস্তরে কলেজস্তরে সংস্কৃত চর্চার সুযোগ আসে, বাংলা গদ্যের জনক নিয়ে একটা বিভ্রান্তি আছে। কেউ বলেন বাংলা গদ্যের জনক রাজা রামমোহন কেউ বলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। এগুলো সঠিক নয়। বাংলা গদ্যের বিকাশ ও ক্রম বিকাশের ক্ষেত্রে কোন একজন ব্যক্তি বিশেষের অবদান নয়। শ্রীরামপুর মিশনারী প্রেসের যারা খৃষ্টধর্ম প্রচারক ছিলেন তারাও ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বিশেষ করে এই উইলিয়াম কেরীর নেতৃত্বে বাংলা গদ্যচর্চার একটা সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা হয় এবং বাইবেলকে বাংলায় অনুবাদ করা হয়। এছাড়াও আমাদের শাস্ত্রীয় গ্রন্থগুলো অনুবাদ করা হয় । কাজেই বাংলা গদ্যের ক্রমবিকাশের ইতিহাসে মিশনারী প্রচারকদের ভূমিকা, রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগেরর ভূমিকা এই সব কিছু মিলেই। কোন একক ব্যক্তির কৃতিত্ব নয়। ডা. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত বইটিতে এর উল্লেখ মিলে।

       বিদ্যাসাগর সর্বপ্রথম মধ্যযুগের বিভিন্ন পাণ্ডুলিপির মধ্যে হাতে লেখা তালপুঁথির মধ্যে যে বাংলা হরফগুলো ছিল এগুলোর কোণ বের করে মাত্রা দিয়ে তিনি সুন্দর এক একটা চেহেরা দেন। এই অক্ষরগুলোকে আজও বিদ্যাসাগর হরফ বলা হয়। হরফের এই চেহারাটা বিদ্যাসাগর স্থির করে দিয়েছেন। বহু পরে পঞ্চানন কর্মকার বিদ্যাসাগরের হাতের লেখাকে মডেলিং করে সিসা ঢালাই করে অক্ষর তৈরী করেন।

      প্রাচীন বাংলা গদ্যে বা পদ্যে কোন যতি চিহ্ন ছিল না। শুধু দাড়ি আর জোড় দাড়িই ছিল। ঈশ্বরচন্দ্র ও মাইকেল মধুসূদন দত্তের যৌথ অবদানের কারণে বাংলাভাষাতে এই দাড়ি, কমা, সেমিকলন, ড্যাস, হাইফেন কিছু বিদেশী যতি চিহ্নের প্রচলন ঘটেছে। বাংলাভাষা স্কুলের ছেলে-মেয়েদের পড়তে গেলে তার যে সিলেবাস বা পাঠ্যক্রম সেটার সুনির্দিষ্ট রূপ দেন বিদ্যাসাগর। ১২টা স্বরবর্ণকে তিনি পৃথক করেছেন চারটা সিরিজ দিয়ে। আর ব্যাঞ্জনবর্ণগুলোকে করেছেন পাঁচটা পাঁচটা করে সিরিজ দিয়ে। স্বরবর্ণের বিন্যাস এবং ব্যাঞ্জনবর্ণের বিন্যাসে এবং আশ্রয়বাদী বর্ণ যেগুলো রয়েছে যাদের নিজের কোন অবস্থান নেই, অন্যবর্ণের আগে বা পরে বসে বর্ণকে অর্থবহ করে। যেমন অনুস্বার (ং) বিসর্গ (ঃ), চন্দ্রবিন্দু ( ঁ) -- এগুলোকে তিনি ব্যাঞ্জনবর্ণের সবশেষে স্থান দিয়েছেন।

      এই শৃঙ্খলাটা একেবারে রবীন্দ্রনাথের শৈশবের যুগ থেকে এখনকার প্রজন্ম পর্যন্ত অনুসরণ করছে। এটা বিদ্যাসাগরের কৃতিত্ব। আর বাঙালির উচ্চারণে আসে এই বর্ণগুলোকে বিদ্যাসাগর যখন শৃঙ্খলাবদ্ধ করছেন তখন তিনি দেখেন বাঙালির উচ্চারণে দীর্ঘ ঋৃ নেই দীর্ঘ ৯ নেই। এই দু’টোকে তিনি তখন বর্জন করেন। এই যুক্তিতে হ্রস্ব ৯ কেও বর্জন করার কথা ছিল কারণ হ্রস্ব ৯ র ব্যবহার বাঙালির নেই। কিন্তু কোমলমতি শিশুদের চারটা চারটা স্বরবর্ণের সিরিজ মিলাতে গিয়ে হ্রস্ব ৯ টা রেখে দেন। যদিও সংস্কৃতে এই দু’টো বর্ণই রয়েছে। আগে সংস্কৃতভাষায় মানুষ শিক্ষালাভ করতেন। কারণ আগে তো বাংলাভাষায় কোনো সিলেবাস বা পাঠ্যক্রম ছিল না। তাই সংস্কৃতভাষায় য়,  ড়, ঢ় বর্ণগুলো নেই। (আষাঢ়, বাড়ি, নিয়ম)। কিন্তু বাঙালি উচ্চারণে এগুলি আছে বলে তিনটা অক্ষর তিনি আমাদের জন্য সৃষ্টি করে দিলেন। এটা বিশাল অবদান তাঁর। প্রথম তিনি আমাদের অক্ষর শেখালেন, প্রতিটি অক্ষরকে ডবল করে একটা করে শব্দ শেখালেন। শব্দকে যুক্ত করে বাক্য শেখালেন। আমাদের জন্য তিনি গল্প রচনা করলেন। যেমন “গোপাল অতি সুবোধ বালক” ইত্যাদি গল্পগুলি।

      আমাদের বাঙালিদের মধ্যে অষ্টাদশ থেকে উনবিংশ শতাব্দিতে যে নবজাগরণ হয়েছে এই নবজাগরণের বড় বড় মণীষীরা প্রত্যেকটা ক্ষেত্রকে ১০০ বছর এগিয়ে দিয়ে গেছেন। তাঁরা সকলেই প্রণম্য। কিন্তু বিদ্যাসাগরকে আমরা কেন প্রাতঃস্মরণীয় বলি ! বলি একারণে যে প্রাতঃকালে শয্যাত্যাগ করেই আমাদের শিশুরা যে ভাষায় পড়ে, যে বর্ণ পরিচয় তারা নেয়, -- এ থেকে প্রথমেই বিদ্যাসাগরের কাছে তাদের ঋণ দিয়ে দিন শুরু হয়, সকালবেলা বিদ্যাসাগরকে স্মরণ করা ছাড়া আমাদের উপায় নেই বলেই তিনি প্রাতঃস্মরণীয়। কাজেই বাংলা ভাষা বাংলা লিপি, বাংলা বর্ণ, বাংলা অক্ষর যতদিন থাকবে ততদিন বিদ্যাসাগরের অবদান থাকবে। এর মানে এই নয় যে বিদ্যাসাগরের আগে আমাদের বাংলা বর্ণ ছিল না অক্ষর ছিল না। আমাদের চর্যাপদের যে কবিতাগুলি রয়েছে তখনও তো বাংলা হরফ ছিল। কিন্তু সেগুলোর সুদৃশ আকার ছিল না বা বড়– চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের যে পাণ্ডুলিপি তাতে গোল গোল অক্ষর একসাথে ঠেসে লেখা। শব্দের মাঝে কোন ফাঁক নেই । এগুলোকে শৃঙ্খলাবদ্ধ রূপ বা সংস্কার সাধন করেছিলেন তিনি।  এই সংস্কারের পর এখন পর্যন্ত আর বাংলা অক্ষরের মধ্যে আর কোনো সংস্কার সাধিত হয়নি। দু’শো বছরের মধ্যে বিদ্যাসাগরের অবদান কতটুকু স্মরণীয় এখানেই তা অনুমেয়। রবীন্দ্রনাথের মতো মানুষও বিদ্যাসাগরের বই শৈশবে পড়েছেন “জল পড়িতেছে, পাতা নড়িতেছে”। এক সময় বিশ্ববরেণ্য কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই বলেছেন -

“বিদ্যাসাগরের চরিত্র বাঙালির জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠিত হইয়া থাকিবে।'



রাজেশ ভট্টাচার্য্য


 

     ব্যর্থ চিঠি

                 ------রাজেশ ভট্টাচার্য্য


শ্রীচরনেষু মা,

আমি তোমার খুকি বলছি।

একবার আকাশ পানে চেয়ে দেখো মা,

তোমার মেয়েটি আজ আকাশের সবচেয়ে বড় তারা  হয়ে ঝলমল করছে।

তোমার মনে আছে মা?

ছোটোবেলায় আমি ডাক্তার ডাক্তার খেলতাম,

কখনো বালিশকে কখনোবা তোমাকে রোগী বানিয়ে নিতাম,

আর আমি হয়ে উঠতাম মস্ত বড় ডাক্তার।

কেউ যখন আমাকে জিজ্ঞেস করত---

কিরে পুচকী বড় হয়ে কি হবে তুই?

আমি অম্লান মুখে বলে দিতাম, আমি হব এক মস্ত বড় ডাক্তার।

পড়াশোনায় খুব ভালোই ছিলাম তাই না মা?

যেদিন মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোলো----

সেই দিনের কথা তোমার মনে আছে মা?

আমি ছিলাম আমাদের স্কুলের একমাত্র ফার্স্ট ডিভিশন।

রেজাল্ট জেনে দৌড়ে এসে

 তোমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়েছিলাম।

কিন্তু সেদিন কি আর জানতাম, আমার স্কুল জীবন এখানেই শেষ!

বাবা আমার সব স্বপ্ন ভেঙ্গে দিল

আমার ভালোর কথা ভেবে।

আমাকে তোমরা এই পৃথিবীর আলো দেখালে,

আমার এই ছোট্ট শরীরটাকে অনেক যত্নে আগলে রেখে বড় করলে মা।

কিন্তু তোমাদের সংসারে আমার আর কটা বছর ঠাঁই হলো না মা।

না না, তোমরা যা করেছ ঠিকই করেছ।

কন্যাদায় যে অনেক বড় দায় মা।

বাড়িতে কন্যা সন্তান থাকলে কত জ্বালা,

লোকে আঙ্গুল তুলে ছি: ছি: করে বলবে---

মেয়েটাকে বিয়েও দিতে পারছেনা।

জানো মা, আমার নতুন জীবনের প্রথম কটা দিন খুব ভালোই কেটেছিল,

ঠিক যেমনটা তোমরা চেয়েছিলে।

তারপর ধীরে ধীরে ডুবে গেলাম অভিশপ্ত জীবনে।

যখন আর তপ্ত ধাতব আমার শরীরে লাগানোর মত জায়গা রইল না,

সেদিন দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকলো তোমাদের যত্নে বড় করা আমার এই শরীর।

তখন খুব কষ্ট হচ্ছিল মা।

আমার যন্ত্রণার কাতর চিৎকারে কেউ এগিয়ে এলো না!

শেষ নিঃশ্বাসে ভগবানের চরণে এইটুকু প্রার্থনা করলাম---

হে ভগবান, তুমি আমার মতো অভাগী কন্যাসন্তানকে,

 কোনো মায়ের কোলে ভুলেও পাঠিও না। 

এখন একবার আমার দিকে চেয়ে দেখো মা,

তোমার খুকি সব স্বপ্ন নিয়ে আকাশে ঝলমল করছে।

এখন আমি খুব ভালো আছি মা, 

খুব ভালো আছি মা,

 খুব ভালো আছি।

অভিষিক্তা রায়



                             অপচয়

                               ------- অভিষিক্তা রায়


যার স্মৃতিতে খুন করেছো রাতের ঘুম রোজ,

সে তো ব্যস্ত বাসর সাজাতে,নেয় কি তোমার খোঁজ??

যার জন্যে আরশিনগর ঢেকেছে অন্ধকারে-

ক্যানভাস তার রঙীন হয়েছে,অন্য কারোর আদরে।

যার কারনে তোমার ঠোঁটে চুমু দেয় নিকোটিন,

তার ঠোঁটে আজ নতুন স্পর্শে উষ্ণ একটা দিন-

যার বারনে ছেড়েছিলে তুমি শহরতলির পথ,

সেই শহরেই নতুন সঙ্গে তার সাজানো স্বপ্নপট।

ফিসফিসিয়ে রাতবিরেতে বলতো কথা যে,

অন্য চোখে চোখ রেখে আজ নিজেকে খোঁজে সে-

যে বলেছিলো হাতটি ধরে,যেওনা প্লিজ ছেড়ে,

সে-ই আবার সুখক্রেতা হয়ে নতুন আশ্রয় গড়ে।

কপালের টিপে,চুলের ক্লিপে খুঁজতে যার গন্ধ,

তার গিটারে,আবদারের সুরে বাজছে নতুন ছন্দ-

শীতের রাতে উষ্ণতা দিতে চাদর দিয়েছো টেনে,

সে-ও এখন চাদর হাতে নতুনের প্রহর গোনে।

বাদলার রাতে বাজের শব্দে আগলে রাখতে যাকে,

দিনের শেষে নতুনকে সে যত্নে আগলে রাখে-

যাকে ভালোবেসে দিয়েছিলে এক পৃথিবী উজাড় করে,

তারই প্রতিদানে ভেঙ্গেছো তুমি বিধ্বংসী এক ঝড়ে।

শিমুল-পলাশ-কৃষ্ণচূড়ায় ভরা সে,ফাগুন মাস,

খুশি ঝলমলে তার চোখে লেখা তোমারই সর্বনাশ-

যাকে পেতে গিয়ে সমস্ত হৃদয় করেছিলে অপচয়,

সে-ই তো তোমাকে নিঃস্ব করেছে,মাপেনি তোমার ক্ষয়।

শান্তশ্রী মজুমদার


 

                           ভ্রমণ কাহিনী 


                      টাইগার হিল থেকে সূর্যোদয় 

                                      ------শান্তশ্রী মজুমদার



       কাঞ্চন জংঘার অমোঘ আকর্ষণ আমার ভ্রমণ পিপাসু মনকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে নিয়ে চললো দার্জিলিং। 

সমুদ্রের উত্তাল ঢেউকে বারবার আলিঙ্গন করেও যেমন অতৃপ্তি থেকে যায় তেমনি ধ্যানমগ্ন গগনচুম্বী পাহাড়ের নিস্তব্ধতা ও আমাকে বারবার তার ছায়ায় নিয়ে যায় অপ্রাপ্তির আকর্ষণে। 

---------

আমাদের ঊনকোটি থেকে শুরু করে দেবতামুড়া, কামাখ্যা পাহাড়, শিবালিক, গাড়োয়াল,ত্রিকূট, হিমালয় ----বহু পাহাড়ের সান্নিধ্যে আসার, পাহাড়ের বিশালতা কে হৃদয়ে ধারণ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। 

---------

২০২০সালের ১০ই মার্চ রওনা দিলাম দার্জিলিং এর উদ্দেশ্যে। দার্জিলিং শহরের চকবাজারেই Hill crown হোটেলে তিনতলায় আমাদের রুম বুক করা ছিলো।

পথশ্রমে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ি প্রথম দিন।

পরদিন ভোরে জানালা খুলতেই দেখি জানালার সামনে শ্বেতশুভ্র কাঞ্চন জংঘা হাসি মুখে দণ্ডায়মান।সকালের সোনালীরোদে হীরার দ্যুতি ছড়াচ্ছে তার বরফাবৃত শরীর থেকে। 

আমার নয়ন জুড়ালো, মন জুড়ালো। দুচোখ ভরে এই নয়নাভিরাম দৃশ্য উপভোগ করতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর মেঘের আড়ালে চলে গেলো কাঞ্চন জংঘা। 

-----------

দার্জিলিং আসার অমোঘ আকর্ষণ ছিলো টাইগার হিল থেকে সূর্যোদয় দেখা। 

ভোর সাড়েতিনটায় হোটেলের সামনে আমাদের ভাড়া করা গাড়ি হাজির। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। সারি সারি গাড়ি চলেছে পর্যটক নিয়ে ----গন্তব্য একটাই টাইগার হিল। 

আমাদের ওয়াগন গাড়ির ড্রাইভার সেলিম তার রেকর্ডারে শিবস্তোত্র বাজিয়ে আমাদের নিয়ে চললো টাইগার হিলের দিকে। 

-----------

টাইগার হিল থেকে সূর্যোদয় -----এক অলৌকিক স্বর্গীয় দৃশ্য।চর্মচক্ষে দেখে জীবন সার্থক করলাম। যখন উদীয়মান সূর্যের প্রথম কিরণ প্রতিফলিত হোল সমগ্র আকাশ জুড়ে, তখন পুরো আকাশটা রক্তিম বর্ণে আলোকিত হোল ----এ দৃশ্য আমার মন প্রাণকে এক অনাবিল আনন্দে ভরে দিলো। 

---------------

হাতজোড় করে প্রণাম করলাম -----

ওঁ জবাকুসুমসঙ্কাশ 

কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিং 

ধ্বান্তারিং সর্ব পাপঘ্নং 

প্রণতোহস্মি দিবাকরম্

--------

সুউচ্চ টাইগারহিলে দাড়িয়ে আমার মতো কয়েক শত মানুষ এই স্বর্গীয় আনন্দ উপভোগ করছে। 

------পশ্চিম আকাশে শ্বেত শুভ্র কাঞ্চন জংঘা আমাদের দেখা দেবে বলে মেঘের চাদর সরিয়ে হাসি মুখে দাড়িয়ে আছে। ---আমি হিমালয়কে দেখছি,আমি তার শৃঙ্গ কাঞ্চন জংঘাকে দেখছি ---এক রোমাঞ্চ কর শিহরণ আমার দেহে।পুব আকাশে লাল টকটকে সূর্যের  ঘুম ভাঙছে.... দিবাকর  প্রকাশিত হচ্ছেন  ধীরে ধীরে.. 

পাহাড়ের নীচে থেকে সূর্য উঠছে... তার রক্তিম আভা প্রতিফলিত হচ্ছে কাঞ্চন জংঘা র চূড়ায়।-----আহা কি দেখিলাম, জন্ম জন্মান্তরেও ভুলিব না। 

আধাঘন্টা স্বপ্নাবিষ্ট ছিলাম। ধীরে ধীরে কাঞ্চন জংঘা চলে গেলো মেঘের আড়ালে। টাইগার হিলে উড়ে আসতে লাগলো মেঘ। মুহুর্তের মধ্যে পুরো পাহাড়টি মেঘে ঢেকে গেলো।মেঘের স্পর্শে ধন্য হলাম আমি।আকাশের মেঘকে ছুঁয়ে দেখছি আমি ---আহা এমন প্রাকৃতিক মাধুর্য ও আমার আমার জন্য অপেক্ষা করছিল।

আমরা দৌড়ে নামছি টাইগার হিল থেকে.....

পথের ওপর দেবাদিদেব মহাদেবের মন্দির, গণেশ মন্দির, হনুমানজীর মন্দির রয়েছে। 

হিমালয়ে দেবাদিদেবের চরণ স্পর্শ করে মানব জন্ম সার্থক করলাম। 

একরাশ ভালোলাগা নিয়ে নিস্তব্ধ পাহাড়ের সাথে আমি ফিরে চললাম......

রাহুল নাগ



                 পূর্ণিমা

                               -----রাহুল নাগ


পাখীরা উড়ে চলেছে ঐ নীল গগনে।

মোর মন যেন চলেছে তাদেরই সনে।।

শান্ত প্রভাত, আজ হবে পূর্ণিমা রাত।

মিলতে যাবে যেন পাখি কাহার সনে।।

তোমাকে দেখেছি তাদেরই মাঝে।

মৌমাছি উড়েছে মৌ নিয়ে যে।।

লাল-নীল প্রজাপতি উড়ে চলেছে।

তোমাকে পেয়েছি তাদের মাঝে।।

ফুলের গন্ধে যেন মন ভরেছে।

পাখিরা উড়েছে নীল গগনে,

তোমাকে পেয়েছি তাদেরই সনে।।

শিশির অধিকারী


    

  তোমাকে দেখেছিলেম

                          -----শিশির  অধিকারী


তোমাকে দেখেছিলেম

সুর্যাস্তের সময় 

কলেজ শেষে হেঁটে হেঁটে

শহর থেকে 

গ্রামে যেতে।


তোমাকে দেখেছিলেম

সূর্যাস্তের সময়

ক্লান্ত মুখ 

কপালে ভাঁজ

কাঁধে ব্যাগ

হাওয়ায় উড়ছে উড়না

চটি পায়ে হেঁটে হেঁটে চলেছ।



তোমাকে দেখেছিলেম 

সূর্যাস্তের সময় 

মাটির রাস্তা দিয়ে

গরুর দল নিয়ে

রাখালেরা যায়

উড়ছে হলুদ বালি

তোমার মুখ

কখনো স্পষ্ট কখনো অস্পষ্ট

উড়ছে চুল 

যেন রনক্ষেত্রে এক নারী।


তোমাকে দেখেছিলেম 

সূর্যাস্তের সময় 

গ্রামের ত্রিমাথায় 

কৃষ্ণচুড়ার নিচে

ছোট ছেলে মেয়েদের 

পড়া ছিলে হাসি মুখে।


তোমাকে দেখেছিলেম

সূর্যাস্তের সময় 

গ্রামের টিউবওয়েল থেকে 

জল দিয়ে হাত মুখ ধোয়ে 

ওড়না দিয়ে মুছতে মুছতে 

বাড়ীর দিকে যেতে ।


তোমাকে দেখেছিলেম

সূর্যাস্তের সময় 

গ্রামের নাটমন্দিরের মাঠে 

বৈশাখী মেলাতে হাসিখুশীতে

অন্য দের সাথে

নাগর দোলায় চড়তে।


তোমাকে দেখেছিলেম

সূর্যাস্তের সময়

কাঁধে ঝুলানো ব্যাগটা

দু-হাতে বুকে চেপে 

বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে 

পথ চলা ।


তোমাকে দেখেছিলেম।

সূর্যাস্তের সময়

অসুস্থ মায়ের  মাথায়

হাত বুলাতে বুলাতে

গান গাইতে।


তোমাকে দেখেছিলেম

সূর্যাস্তের পর 

সন্ধ্যা প্রদীপ হাতে নিয়ে 

এক শুদ্ধ তার প্রতীক রূপে।।।


তাপস


 

       বীরের রক্ত

                   ------তাপস


চোখের জল ফেলোনা ,

চোখকে ভিজতে দিওনা ,

এতো ভাবনা কিসের?

আমার স্বপ্নের দেশ

তোমার কোলে এখনো

হয়নি আমার ঠাঁই।

মা বাবা বলে ডাকা হয়নি ,

বাইরের জগৎ কেমন সেটা ও জানিনি ,

কিন্তু দুঃখিত নই আমি ,

তবুও ভাগ্যশালী গৌরবশালী আমি,

যার পিতা যুদ্ধে অগ্রণী সৈনিক

আমি সে পিতার সন্তান। 

যে সামনে দাঁড়িয়ে শত্রুর উপর গুলি বর্ষণ করেছিলো ,

তিরঙ্গার জন্য দাঁড়িয়ে

 কসম খেয়ে দেশের ,

প্রাণ ভিক্ষা দেয়নি শত্রুর।

এটা চিতা না অম্বিত্যেরবেদী ,

গর্ব হয় শহীদ আমার পিতা,

তোমার সীমন্ত খালি হয়নি আরো লাল হয়ে গেছে।

যখন চোখের জলে ভাসছে দেশ ,

বীরের প্রতিমূর্তি তোমার চোখে জল আসেনি ,

যখন পিতার অস্তি কাঁধে তুমি চলেএসেছ,

যে দেশের জন্য আমার পিতা দাড়িয়ে ,

যেখানে আমার মার মত শক্তির গল্প আছে ,

 ভেবো না আমি শোকে  থাকবো,

তোমার জঠরে বীরের রক্ত আছে।

বর্ণা দাস


 

          

               বন্দিদশা  


                               ------ বর্ণা দাস


মহামারীতে বন্দি দশায় আটকে ,

কাটছে সবার জীবন  ;

সময়ের গতি হচ্ছে নাকো পার ।


মহামারীর শেষ আসবে কখন  ,

কবে বন্দিদশা কেটে মুক্ত হবে জীবন  ;

সেই আশাতেই কাটছে দিন সবার ।


একটা সময় মানুষ ছিল মুক্ত  ,

বন্দি ছিল পশুপাখি  ;

অত্যাচারে জর্জরিত প্রকৃতির গাছপালা পশুপাখি জলস্থল ।


কীসের অভিশাপে যেন গ্রহণ লেগেছে বিশ্বে  ,

আজ একই নিয়মে প্রকৃতি মুক্ত অথচ মানুষ বন্দি  ;

সত্যি কী অভিশাপ , নাকি মানবজাতির কর্মের ফল ?


মনে পড়ে সেই অত্যাচারের নির্মম দৃশ্য  ?

যেথায় প্রকৃতি মায়ের কোল খালি করে ,

তৈরি হচ্ছিল বিশাল অট্টালিকা পাহাড় ।


আজ যেন সেই একই ভাবে ,

বিশ্ব মেতেছে ধ্বংসলীলায়  ;

চারিপাশে শুধু মৃত্যু মিছিল ,

যেন তিলে তিলে গ্রাস করছে অন্ধকার ।


যদি কেটে যায় এই মহামারী ,

ফুরিয়ে যায় বন্দিদশা  ;

তবে মনে করো দ্বিতীয় জন্ম হল আবার ।


প্রকৃতি তো মায়ের মতোই স্বচ্ছ শীতল হয়  ,

যদি তাকে যত্ন করে আগলে রাখো ,

সেও তোমায় যত্নে আগলে রাখবে ;

যদি না করো তার উপর নির্মম  অত্যাচার  ।

মধুমিতা ভট্টাচার্য


 

    ভালোবাসার জন্মদিন 

                           ------মধুমিতা ভট্টাচার্য


আজ আমার ভালোবাসার জন্মদিন 

না, না শুধু আমার কেন? 

আজ তোমারও ভালোবাসার জন্মদিন।

আজ, আমাদের ভালোবাসার জন্মদিন।

তোমার মনে আছে 

সেদিন তুমি ঈশাণের রোদ মেখে, কপালে

আস্ত এক পৃথিবী এঁকে, এক পৃথিবী 

ভালোবাসা  বুকে পথ হাঁটছিলে থেমে থেমে ভয়ে ভয়ে।

হঠাৎ , আমার চোখে পড়ল তোমার চোখ ,

দুজনেই দুজনের দিকে তাকিয়ে রইলাম অনন্ত যুগ ধরে, 

তারপর -হাতটা বাড়িয়ে দিলাম।

বললাম -তুমিই সেই 

যাকে খুঁজে চলেছি

কত নদী, সাগর পেরিয়ে, তুমিই সেই।

আদি থেকে অন্তের পথে, 

সত্য থেকে সুন্দরের উপাসনায়, 

ধ্বংস থেকে সৃষ্টির আনন্দে।

তুমি বললে -''আমার কোনো 

নাম নেই, 

পদবী নেই, 

শেকড়ের খোঁজ নেই

'আশ্রমতীর্থ 'আমার স্বর্গ।''

আমি বললাম -সেই স্বর্গ থেকেই তো তুমি নেমে এসেছো, 

নামে কি আসে যায়? আর পদবী সে তো বানানো।

তুমি নারী এটাই প্রকৃতি, 

আমি পুরুষ এটাই সত্য।

তবে, তুমি চাইলে আমি ভালোবেসে তোমাকে ঝর্ণা বলে ডাকবো।

আমি পুরুষ -লোকে বলে পাথর।

সেই পাথরের বুক বেয়ে তুমি 

ভালোবাসার ঝর্ণা হয়ে ঝরে পড়বে।

তুমি হেসে হাতটা বাড়িয়ে দিলে।

সেই থেকে কেটে গেলো কত মাস, কত বছর হিসেব রাখেনি।

শুধু ভালোবেসেছি , 

তোমার বুকের শীতল জলে অবগাহন করেছি, 

তোমার দুরন্ত খোলা চুলে মেঘের স্বাদ পেয়েছি, 

আমার উষ্ণ মরুভূমিতে তুমি বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়েছো, 

আমি পূর্ণ হয়েছি তোমার স্পর্শে।

এসো, আজ ভালোবাসার 

জন্মদিনে তোমাকে নীলপদ্ম 

উপহার দেবো ।

তুমি বললে -''না, না 

নীলপদ্ম আমার চাই না, 

ওখানে মৃত্যু ফণা তুলে 

আছে।

আমি বললাম -ভয় নেই , 

ভালোবাসার শুধু জন্ম হয় 

  মৃত্যু হয় না।

শুক্লা রানী দাস


       নারী দিবস

                     ------শুক্লা রানী দাস


নারীদিবস হোক মানবজীবনের স্বীকৃতি 

নারীদিবস হোক 

সত‍্য পরম প্রকৃতি।

নারীদিবস হোক 

জীবনে রবির রং এর ছটা।

নারীদিবস কেবল পুরুষতান্ত্রিকতারবিরোধিতা নয়

নারীদিবসে চাই অধিকারের প্রতি বিশ্বস্ততা

পারস্পরিক ভেদাভেদ নয়,

চাই সম্পর্কের নির্ভরতা।

নারীদিবস কতিপয় নারীবাদীর জন্য নয়।

নারীদিবস মায়েদের লালন পালন ও পরিচর্যার স্বীকৃতি।

শ্যামল রায়


 

        তবুও বৃষ্টি নামুক

                          ------শ্যামল রায়


বিবেকের মরুভূমিতে বৃষ্টি নেই

চোখ পড়লে দেখা যায় খাদ

সবুজতা শুধুই হলদে রঙের ফ্যাকাশে জমি

বৃষ্টি নামুক বৃষ্টিতে ভিজুক

আমাদের বিবেক।

ভালোবাসা জন্মাক, বৃষ্টি পেয়ে

তাই বৃষ্টি আসুক বৃষ্টি নামুক

জীবন চিত্রে---।

চারদিকের বিবর্ণ পাতাগুলো সব ঝরে যাক

গজিয়ে উঠুক সদ্য প্রস্ফুটিত ফুল

আর সদ্য কেনা শাড়ির ভাঁজে

ভালোবাসার মুখ আয়না হোক

বৃষ্টি আসুক বৃষ্টি নামুক

সবুজে ভরে যাক

তোমার আমার দেশ।

সকলে মিলে দেখবো নীল আকাশটায়,

হরেক রঙের ছবি

বৃষ্টি নামুক বৃষ্টি আসুক

চলো ভিজি বৃষ্টিতে ।

বিবেক বৃষ্টি চাইছে

ভালোবাসা সম্পর্ক চাইছে

স্বপ্ন চাইছি কবিতার মত

তুমি মেঘ হও

তুমি আঁচল ওড়াও

এসো ভালোবাসাবাসিতে ।

বাঁশিতে সুর বেজে উঠুক

মরুভূমির বিবেক জুড়ে

বৃষ্টিতে ভিজবো এক চাদরে

বৃষ্টি আসুক বৃষ্টি নামুক

বিবেক মরুভূমি জুড়ে।

গোপাল বনিক


 

             আমার জীবন শুধু আমারই

                                        -----গোপাল বনিক 


আমি পদতল বন্দনা করে বিনয়ী হতে চেয়েছিলাম-

কিন্তু তারা ভাবলো আমার দুর্বলতা,

আমার সৌজন্যতা পরিণত করলো হীনমন্যতায়।

তবে এসো আজ ম্রিয়মানতার খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসি

প্রশ্নবাণ ছুঁড়ে মারি তোমার বুকে

ঝলসে উঠুক বিদ্যুতের মতো-


যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে ভরে উঠে তোমার লক্ষী ভান্ড।

পোড়ারুটি খেয়ে তোমার জন্য গড়ে তুলে ইমারত,

ঝড় জল এক করে তোমাকে বসায় মখমলের নরম কেদারায়।

যাদের রক্তে ভিজিয়ে নাও তোমার জীবনের ভোগ।


আর কতদিন চলবে এই দাসরক্ত ধারা

আর কতদিন অভুক্ত শিশু পথ জুড়ে মরে বেঁচে থাকবে?


আমরা চাই অশ্রুঘামে সুদিনের ঘ্রাণ

আমার পথ শিশুটিই হোক নির্মাণের অধিকর্তা

নররক্তভুক ভুয়া নিরাপত্তার চাঁদর সরে যাক

উঠে আসুক সাম্যদূতের নব প্রজন্ম।


সহিষ্ণুতা তোমায় দিলাম আজ ছুটি।

পদ লালিত্য আজ বন্ধ হোক,

মুষ্টি বদ্ধ হাত গর্জে উঠুক

বলুক আমার জীবন শুধু আমারই।

মিঠু মল্লিক বৈদ্য


    

 "আগমনীর প্রতিচ্ছবি"

                      ------মিঠু মল্লিক বৈদ‍্য


সবে দেখো চেয়ে,

সেজেছে আজ সে নববধূর সাজে।

রামধনুর সাতরঙ্গেতে সাজিয়ে আপনারে

নেমেছে ভুবনে পুঞ্জ মেঘের কোলে ভেসে।


পড়নে ময়ূরপঙ্খী,তণ্বী অপরূপী!

শিউলীর শুভ্র পরিমলে

মধুমঞ্জুরীর রমনীয়তায়,

তুমি প্রাণোচ্ছ্বলা।


রৌদ্রছায়ার মায়াবী খেলা,

নীলাকাশে সাদা মেঘেরভেলা,

অদূরে কাশফুলের সিগ্ধতায়

 মোহনীয় তুমি।


দখিণ সমীরণ,মুক্ত বাতায়ন;

নির্মল জোছনা ভরা নীরব যামিনী;

সবুজ ক্ষেতে সোনালী আলোর ঝিকিমিকি

তুমি আসমানী পরী।


শিশির ভেজা ঘাস,শিউলীর আস্তর

প্রভাত রবির চিক্কণ আভায়

যেন মুক্তাদ‍্যুতির

আলোকঝর্ণা।


অদূরের শান্ত জলে মেঘভেলার ছায়া,

বিলে শাপলা শালুকের মৌ-মৌ সুভাস,

ছুটির আমন্ত্রণ,উৎসবের হাতছানি

শরৎরানী তুমি ;আগমনীর প্রতিচ্ছবি।

তাপীব (ছদ্মনামে)

     

         সন্ধিক্ষণে 

                  ------তাপীব (ছদ্মনামে)


জীবন’-আমার খেলার মাঠ,

‘মৃত্যু’-তুমি রাত্রি;

চির-অনন্ত সন্ধি-যুগল-

আমি অভিযাত্রী ।।


গ্রন্থ-কেতাব- শেষ হরফে,

হুইস্যল উপরতি;

লুপ্ত-সত্তার গন্ডী’ পরে-

গোধূলির চিহ্ন-যতি।।


জীবন-রমন আভিজাত্যে-

ক্লান্ত-শমন উপাঙ্ক;

শঙ্কা কোথায়! উপলব্ধ-তৃপ্তি;

প্রশান্তির ঘনাঙ্ক।


স্থিতি’র প্রভব, বিয়োগান্তে-

প্রণয়ান্তে ঊঢ়ি;

চিতা-বহ্নি নিশান ছড়ায়-

বর্গীয়-প্রত্যাশা সঞ্চারি।।

অনামিকা লস্কর ভৌমিক


     কথা ছিলোনা

             ------অনামিকা লস্কর ভৌমিক


শ্রাবণের অভিসার

নিবিড় বন্ধন,

খোলা আকাশের নিচে

রোদ বৃষ্টির লুকোচুরি

রুমালের স্পর্শে

মুছে গেলো পাতার

অভিনন্দন বৃষ্টিকণা

পাখিরা সঙ্গী ছিলো।


কথা হলো

পারিজাতহীন অনন্তযৌবন

ভালোবাসার মাদকে

বিহ্বল তনু,

একাকার হবে নিরালায়।

ভুলেছি পথ

ধানের ভ্যাপসা গন্ধ

পাতার আগুনে

কালো ডেকচির ভাত

খরের চালের ছিদ্র।


কথা ছিলোনা

বসন্তের আগুনে,

বজ্রপাতের ধ্বনি,

সহসা দেবে দেখা অকারণ।

স্বপ্নের পৃথিবীটা 

পাক খাবে গোলোকধাঁধায়,

সোনায় বাঁধানো সিঁড়ি হবে

ভঙ্গুর ধ্বংসস্তুপ,


বেলাশেষে দেখা হলে

দুচোখ ভরে উদাসী নয়ন

দেখে নেবে কান্ত সৌম্য দিপ,

পাখীদের ডেকে নেবে

শ্রাবনের দিনের,

কেন পাখি পোড়া মরিচে পান্তা

চারদিকে আর্তের ধ্বনি

শ্মশানের স্তবিরতা।

কাজী নিনারা বেগম


           

   মুক্তির আকুলতা 

                  ------কাজী নিনারা বেগম 


চেয়ে দেখি আঁখি জল। 

সাগরে ধাবমান নদী।

নিরন্তন রসের সন্ধানে

এই মহাবিশ্বের মহামিলনে

সেতু বন্ধনে পিছিল পথে

জাগতিক বিরম্বনায় বিপ্লবের

নিনাদ স্বপ্ন এর আশায়।

তবু তার সন্ধানে দিবারাত্রি।

প্রলোভিত মনে মুক্তির আকূলতায় 

বেদনার গিরিশ হিমালয় ,

বরফাকৃতি অকুণ্ঠ, ভক্তি প্রবাহে, বিগলিত শতধারা,

তবু মহাপুরুষের মহিয়ান ,

কোন অভিমানে পালিয়েছ বাহিরে।

শুন্য মন্দিররে  ফূল শয্যা আগলে,

আমি রহিলাম অনুক্ষন তোমারি প্রতিক্ষায়।

মাম্পী সরকার


                  

                           বিষন্ন 
                                -------মাম্পী সরকার


                ক্লান্ত মন ছিন্ন হৃদয়, 

            বহিছে ফাগুন বিষন্নতায়।

         চারিদিকে লাগল রং এর দোলা,             

    কিন্তু মোর মনে নাহিকো ছিন্নচ্ছটা। 

            রং এর দেশে রং এর বশে, 

                 রং মাখে বহু বেশে। 

                 পাল্টায় রং বহুবার, 

               গিরগিটিরে মানায় হার।। 

                  দেখিয়া তাদের রং,

                 ক্লান্ত হইল মোর মন।। 

                 ফাগুনে বহিছে নেশা,           

                 তাতে আবার সর্বনাশা, 

                   দুরভিসন্ধি ভরা মন, 

                  ছিন্ন করে অটুট বন্ধন।। 

                 কত রং এ রাঙিয়া সবাই, 

                    রং পাল্টায় ভাই ভাই।। 

            নিজের আখের গুছিয়ে নিয়ে, 

                 সবাইকে পথে বসায়।। 

                   মিথ্যার প্রশস্ত পথে, 

                  ছুটে যায় শ এ শ এ।। 

                 সত্য শুধু দাঁড়িয়ে থাকে, 

                   নির্জন একাকী পথে।। 

                   তবুও সে লক্ষ্যে চলে। 

                 ভরসা তার সত্য বলে।। 

             এইটা কি ভাই রং এর খেলা? 

                যেখানে সব ছেলেখেলা! 

                 আমার রং সেদিনই হবে, 

                যেদিন সবাই সমান রবে।।

সঙ্ঘমিত্রা

 

       আগামীর প্রতীক্ষা
                     
                      ------সঙ্ঘমিত্রা 


হারিয়ে গিয়েও ফিরে আসি

অক্ষরের রূপোলী আলোর স্বপ্নে,

সত‍্যের সন্ধানে অনন্ত মেঘ ঢাকা।

বিশীর্ণতার মাঝে তত্ত্ব করি ভালোবাসার

কথামালার ডালায় বাজে প্রত‍্যাশার তানপুরা।


হাজার ক্ষতস্থানে মায়াদের                                           

দেখা যায়

শিখা বেঁয়ে ওঠে মনের জানালার 

কাঁচ ঘেঁষে,

কাঁচের দাগে স্মৃতির আঁচড় মিশে গেছে

মুক্তির ভোরের আলো হাতছানি 

দেয় প্রাণোচ্ছল ক‍্যানভাসে

ছানিপড়া ঝাপসা দু'চোখে তৃষ্ণার ছাপ।

চাঁদোয়াও প্রহর গুনে গুনে একটি পূর্ণিমা পায়।

আগামীর প্রতীক্ষা নবোদিত সূর্যের নেশায়!!

লিটন শব্দকর


                      খেলাঘর
                         
                            -----লিটন শব্দকর


এই যে পৃথিবীর সাথে তোমারও প্রতিদিন

আমাকে জায়গা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার ধারাবাহিকতা 

তাও আমি আচমন করি আহ্নিক ভেবে!

এতেই বোধের ঘরে প্রবেশের মুক্তি ও সাধনা, 

সেখানেই পাখিদের কূজন কখনও 

গোশালিক, বনবাটান অথবা কিছু পাখি অজানা,

বাতাসের সাথে ছলনায় অশরীরী ডাকে,

কাছেপিঠে কোথাও মৃত্যু লুকিয়ে বেড়ায়,

সবটুকু ব্রহ্মাণ্ড যেখান থেকে দৃশ্যমান 

সেমাঠেই হলুদ দুপুর আর নিবিড়তা দোল খায়।

দিলীপ বনিক


               

               মৌনী 
                        ------দিলীপ বনিক     
  

     

বসে থাকি নিরবে নিরালায় ---- 

ভাবি এ জগৎ কত নিঠুর !

মানুষে মানুষে ভেদ - বিভেদ ,      

 যখন কাটিয়ে উঠে দাঁড়াইছে       

 এই সমাজ ------                          

তখনই অদৃশ্যে হেসে লুটোপুটি   

 হন খান্ খান্ --- বিধাতা !         

 তো এতো মাখামাখি কিসের ? 

 এসেছো একা , যাবে একা---

 জীবন নাটের এই তো খেলা !     

ভেঙে হ'বে চুরমার সকল নৈকট্য , 

প্রেম , প্রীতি আর ভালোবাসা ----   

বলা যাবে না কো কথা , 

যা অযথা বাক্য ব্যয় !                       

থাকো মৌনী হয়ে , 

যে ক'দিন আছো এই ধরায় ॥

সাগর কুমার আচার্য্য


                          বিলাপ    

                             ------সাগর কুমার আচার্য্য

                        

স্তব্ধতা মোর পথের সাথী, স্তব্ধ আমি অবাক আমি, 
অসীম জ্ঞানের ভান্ডারেতে ক্ষুদ্র কোনো পাত্র আমি l  
বিশাল জ্ঞানের ভান্ডারেতে ক্ষুদ্র আমার আসন খানি, 
ঝুকে ঝুকে প্রণমি তাঁরে অসীম জ্ঞানের কান্ডারি l        
সমাজেতে বাস আমার ক্ষুদ্র কায়া দেহ, 
অজ্ঞানতার কুটির বাসি আমি কাহার কেহ?               
আমার মুখের ভাষা খানি কন্টকেরো বুলি, 
এমন প্রতিত হয় বুঝি আমার কাছের সাথী?                
না বলা মোর কথা সবই বুঝতে ওরা রাজি, 
না বুঝে সব আমার প্রতি ভুল ধারণায় রাজি।
বলতে গিয়ে গোলাপ কথা ভাবের তরি ভাসি, 
বর্ণনাতে তাই আমারই কন্টকেরো ধ্বনি।                    
ভিতর কথা না বুঝে শুধু উপর কথা শুনে।                
দ্বৈর্থকতার ভাষার বুলি বলি সবার সাথে,  
কেহ বুঝে কেও আবার কাটা সম দেখে।     
স্তব্ধ আমি প্রতুত্তরে কোনো কথা না বলি।
হেঁসে হেঁসে দেই উড়িয়ে কঠিন কঠিন বুলি।                  
হাঁসির মাঝে গভীর কোনো ভাষা নেইতো তাতে?         
বুঝতে কী চায় কখনো ওদের বিলাপ মাঝে!

পায়েল মজুমদার

 

      

       সে মেয়েটি আমি
                                               
                 ------পায়েল  মজুমদার

সে মেয়েটি আমি--
চোখে যাদের অফুরন্ত স্বপ্ন,
স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দিতে সামিল হতে হয় কঠিন লড়ায়ের। 
ময়দানে কেউ বা জিতে যায়,
কেউ বা পৃথিবী ছেড়ে চির বিদায় নিয়ে যায়। 

 সে মেয়েটি আমি--
ডিগ্রি অর্জনের জন্য যাদের দেহ
তুলে দিতে হয় শিক্ষক নামক কিছু নর পিশাচের হাতে। 

সে মেয়েটি আমি--
একরাশ ভয় ও নিরাপত্তাহীন হয়ে যাদের 
বাড়ি হয়ে বেড়োতে হয় রোজ।
সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার সময় কিছু রক্ত চোষক 
যাদের ভক্ষণ করে,রক্তাক্ত করে, নিথর দেহ 
ফেলে রাখে রাস্তার পাশে। 

সে মেয়েটি আমি--
যাদের শাড়ির ফাঁকে উদর দেখা গেলে কিছু 
মানব রুপি জানোয়ারদের উত্তেজনা বেড়ে যায়। 
এমনই এক উদর থেকে তারা জন্ম নিয়েছিল।

সে মেয়েটি আমি--
স্বামী পরকীয়ায় লিপ্ত যেনেও
তার সাথে সংসার করে যেতে হয়। 
পনের জন্য যাদের প্রতিনিয়ত
নির্যাতিত আর অগ্নিদগ্ধ হতে হয়।

সে-মেয়েটি আমি---
সামাজিক মাধ্যম, ট্রামে, বাসে যাদের
হেনস্থার শিকার হতে হয় প্রতিদিন। 

হ্যাঁ,
সে মেয়েটি আমি--
সমাজে যাদের লাঞ্ছিত,বঞ্চিত,শোষিত 
হয়ে থাকতে হয় প্রতি পদে পদে।