--------জ্যোতির্ময় রায়
বিদ্যার সাগরই বটে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। যদিও উপাধিপ্রাপ্ত প্রথম বিদ্যাসাগর হলেন শ্রীচৈতন্যদেব। প্রাক্ ব্রিটিশ পযার্য়ে বিদ্যাসাগর ছিলেন তিনিই। পরবর্তী সময়ে বিদ্যাসাগর উপাধিপ্রাপ্ত পণ্ডিতরা হলেন মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, মদনমোহন তর্কালঙ্কার, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী প্রমুখ। বিদ্যাসাগর পূর্ববর্তী ছিলেন মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার। পরপর এতজন পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব বিদ্যাসাগর উপাধি অর্জন করলেও সাহিত্যসমাজে বা বাঙালি জীবনে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়েরই বিদ্যাসাগর বলে বহুল মান্যতা রয়েছে। ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধিটাই ইশ্বরচন্দ্র-এর পৈতৃক উপাধি বন্দ্যোপাধ্যায় এর স্থলে স্থায়ী স্থান লাভ করে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নামে জনমনে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। প্রকৃত অর্থে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাঙালি জীবনে একজন যথার্থ প্রাতঃস্মরণীয় মণীষী।
ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবনের সাধনায় ছিল দেশে মুক্তমতি নতুন মানুষ তৈরী করা এবং তারই শিক্ষার প্রসারকে তিনি তাঁর জীবনের অন্যতম প্রধান কাজ বলে বেছে নিয়েছিলেন। প্রায় ১৭৫ বছর আাগ বারানসীর সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ ড. ব্যালেন্টাইনের মন্তব্যের উত্তরে বিদ্যাসাগর লিখেছিলেন - “প্রয়োজন বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষার। শাস্ত্রে যাদের অন্ধ বিশ্বাস তাঁরা কখনও এই শিক্ষা দিতে পারবেন না। ..... লজ্জায় আমার মাথা নত করে বলতে হচ্ছে যে ভারতের ধর্মান্ধ পণ্ডিতেরাও মনে করেন যে প্রাচীন ঋষিরা যে শাস্ত্র রচনা করেছেন, তা একেবারে অভ্রান্ত। পরীক্ষা-নীরিক্ষার ভিত্তিতে বৈজ্ঞানিক সত্যানুসন্ধান তাঁদের চরিত্রবিরোধী” --- (বিদ্যাসাগরের চিঠি, বিদ্যাসাগর রচনা সংগ্রহ, প্রথম খণ্ড : পরিশিষ্ট) আজ একবিংশ শতাব্দিতেও বিদ্যাসাগর যে যথার্থ তার প্রমান মিলছে।
২০২০ ইংরাজীতেও করোনা সংক্রমন রোধে লাইন ধরে গোমূত্র পান করানোর মতো পশ্চাদ্গামীতার বার্তা সজীব। কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ও বন্ধনশীলতার সমালোচনায় বিদ্যাসাগর প্রায় দুই শতাব্দি আগেও সরব ছিলেন। বিজ্ঞানসম্মত নীতির ভিত্তিতে নতুন শিক্ষা ব্যবস্থার রূপরেখাটির স্পষ্ট ইঙ্গিতও তিনি করেছিলেন :-
ক) বাংলাদেশের শিক্ষা পরিচালনার ভার যাঁরা নিয়েছেন তাঁদের প্রথম লক্ষ হওয়া উচিত সমৃদ্ধ ও উন্নত বাংলা সাহিত্য সৃষ্টি করা।
খ) যাঁরা মূল ইউরোপীয় জ্ঞানভাণ্ডার থেকে শিক্ষালাভের উপকরণগুলি সংগ্রহ করতে অক্ষম, এবং যাঁরা সেই জ্ঞানরাজি সহজ ও উপযুক্ত বাংলা ভাষায় প্রকাশ করতেও অক্ষম, তাঁরা কখনই এই ধরণের সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারবেন না।
গ) মনুস্মৃতি, মিতাক্ষরা দায়ভাগ প্রভৃতি নিশ্চয় পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত থাকবে, যাতে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা সম্বন্ধে ছাত্রদের জ্ঞান সম্পূর্ণ হয়।
ঘ) গণিত, বীজগণিত নিশ্চয় পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভূক্ত থাকবে, তবে তা সংস্কৃত ভাষার মাধ্যমে না পড়ে ইংরাজী ভাষারমা মাধ্যমে পড়াই শ্রেয়।
ঙ) বাংলাভাষায় পাশ্চাত্য সংস্কৃতির ভাবধারা যথাযোগ্যভাবে প্রকাশ করতে হলে বাংলায় বৈজ্ঞানিক পরিভাষা সৃষ্টি করতে হবে ও পণ্ডিতদের তা আয়ত্ত করতে হবে।
চ) প্রতীচ্য ও প্রাচ্যের সমস্ত মতের দর্শনই ছাত্রদের পড়ানোর ব্যবস্থা রাখতে হবে, যাতে বিভিন্ন মতবাদের স্বপক্ষে ও বিপক্ষে নানান যুক্তি-তর্ক পড়ে, ছাত্রদের নিজস্ব স্বাধীন মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠতে পারে। (বিদ্যাসাগর : “নোটস অব সংস্কৃত কলেজ”, বিদ্যাসাগর রচনা সংগ্রহ, প্রথম খণ্ড)।
সমাজসভ্যতাকে এগিয়ে নিতে শিক্ষাকে সার্বজনীন বোধগম্য ও যুক্তিবাদী বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে বিদ্যাসাগরের কথাগুলির প্রাসঙ্গিকতা কালোত্তীর্ণ নয় কি ? সংস্কৃত ভাষার পণ্ডিত হয়ে তিনি উপলব্ধি করেন বাংলা প্রদেশে বাংলাভাষার গুরুত্ব। বাংলার গভর্নর হ্যালিডের কাছে স্কুল-শিক্ষানীতি সম্বন্ধে বিদ্যাসাগর এক প্রস্তাবনা দিলেন। সালটা ১৮৫৪। প্রস্তাবনার ১১ নং অনুচ্ছেদে তিনি লিখেন :
“১) সমগ্র স্কুলে শিক্ষাদান ও শিক্ষাব্যবস্থা বাংলাভাষায় হওয়াই একান্ত জরুরী, কেননা একমাত্র তার সাহায্যেই জনসাধারণের শ্রীবৃদ্ধি সম্ভব।
২) ভাষা ও গণিত শিক্ষার মধ্যে এ পাঠ্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। শিক্ষা সম্পূর্ণ করার জন্য ভূগোল, ইতিহাস, জীবনচরিত, গণিত, জ্যামিতি, বীজগণিত, পদার্থবিজ্ঞান, শরীরতত্ত্ব, নীতিবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান ছাত্রদের শেখানো অবশ্য প্রয়োজন”।
আজ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বাংলাভাষী স্কুল তুলে দেওয়া হচ্ছে। বাংলা মাধ্যম তুলে দেওয়া হচ্ছে। বিজ্ঞান বিষয়ের স্কুল সংখ্যা হ্রাস করা হচ্ছে। বিজ্ঞান বিমুখতার দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে প্রজন্মকে। এমনকি বিদ্যালয়ের সংখ্যাও কমিয়ে শিক্ষার সুযোগকে সংকোচিত করা হচ্ছে। অথচ ১৮৫৪ সালে বিদ্যাসাগরকে যখন সহকারী বিদ্যালয় পরিদর্শকের পদাসীন করা হয় তখন তিনি মাত্র চার বছর কার্যকালের মধ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় ২০টি মডেল স্কুল ও মেয়েদের জন্য আরো ৩৫টি স্কুল স্থাপন করেন। মেয়েদের উচ্চশিক্ষার জন্য বেথুন সাহেবের সহায়তা নিয়ে কলকাতায় একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। যার বর্তমান নাম বেথুন কলেজ। এভাবেই তিনি স্ত্রী শিক্ষার চারাগাছটিকে লালন করে গেছেন। অজ্ঞতা ও অশিক্ষার আব্রু থেকে জ্ঞানের আলোকের দিকে বের করে আনার পথ প্রদর্শক বিদ্যাসাগর।
মেয়েদের প্রতি অপরিসীম মমত্ব ছিল তাঁর। সমস্ত রকম অমানবিক, অনৈতিক দেশীয় আচার প্রথার দৃঢ় বিরোধীতা ছিল তাঁর চরিত্রের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট। ধর্মীয় ভেদাভেদ বা জাতপাত তিনি কখনোই মানতেন না। উচ্চবংশীয় ব্রাহ্মণসন্তান হয়েও তিনি কলেরা রোগাক্রান্ত এক মেথর মহিলার সেবা করে সুস্থ করে তোলেন। কত মুসলমান শিশুকেও তিনি নিজ কোলে বসিয়ে আদর আহ্লাদ করেছেন। বিশেষত: বর্ধমানে বসবাসকালে তাঁর এ ছবিগুলি অনেকেই প্রত্যক্ষ করেছেন। কার্মাটরে দরিদ্র অসহায় আদিবাসী মহিলা ও পুরুষদেরে তিনি নিজ হাতে খাদ্য বিতরণ করেছেন।
তিনি যা ভাবতেন তা বলতেন এবং যা বলতেন তা করে দেখাতেন। তখনকার সময়ে ছেলেমেয়েদের পড়ার জন্য বাংলাভাষায় কোন বই ছিল না। বিদ্যাসাগর এ নিয়ে কাজ শুরু করলেন। বর্ণপরিচয়, বোধোদয়,, কথামালা, আখ্যানমঞ্জরী, বেতালপঞ্চবিংশতি রচনা করে বাংলা ভাষার নতুন যুগ সূচনা করলেন। ঐ সময়ের শিশু রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী সময়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়েন ঐ রচনাগুলি নিয়ে। মেয়েদের উচ্চশিক্ষার জন্য বিদ্যাসাগর অনেকগুলি কলেজ বেসরকারি উদ্যোগে করে গেছেন। শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর ‘আত্মচরিত’-এ লিখেছেন ‘উনবিংশ শতাব্দির শেষভাগে বঙ্গদেশে বেসরকারি উদ্যোগে যে সমস্ত কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাদের সকলেরই ধ্রুবতারা ছিল বিদ্যাসাগরের মেট্রপলিটান কলেজ।” ১৮৭৩ সালে বিদ্যাসাগর ঐ মেট্রপলিটান কলেজেটি প্রতিষ্ঠা করেন। যার বর্তমান নাম বিদ্যাসাগর কলেজ।
কথায় ও কাজে, বিঘোষিত আদর্শ ও ব্যক্তিগত আচরণে, সমাজ-জীবনে ও ব্যক্তিগত জীবনে এমন সঙ্গতিপূর্ণ আচরণ ভারত বাংলার নবজাগরণের পতাকাবাহী আর কোন মণীষীর চরিত্রে মেলা ভার। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখায় যথার্থই পাই - “আমরা আরম্ভ করি শেষ করি না, আড়ম্বর করি কাজ করি না, যাহা অনুষ্ঠান করি তাহা বিশ্বাস করি না, যাহা বিশ্বাস করি তাহা পালন করি না, ভুরি-পরিমান বাক্যরচনা করিতে পারি, তিল-পরিমান আত্মত্যাগ করিতে পারিনা, আমরা সকল কাজেই পরের প্রত্যাশা করি অথচ পরের ত্রুটি লইয়া আকাশ বিদীর্ণ করিতে থাকি .... বিদ্যাসাগর সব বিষয়েই ইহার বিপরীত ছিলেন। .... দয়া নহে, বিদ্যা নহে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর চরিত্রে প্রধান গৌরব তাঁহার অজেয় পৌরুষ, তাঁহার অক্ষয় মনুষ্যত্ব।”
আমাদের বাংলা ভাষা বাংলা বর্ণ এগুলো বিস্তারের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর ভূমিকা খুব বেশি। বিদ্যাসাগর পাণিনি রচিত অষ্টাধ্যায়ী সংস্কৃত ব্যাকরণের সুললিত বাংলাভাষায় অনুবাদ করে বাঙালিদের মধ্যে ব্রিটিশ পরবর্তী সময়ে সংস্কৃতচর্চার পথ করে দেন। একটা সময় নবদ্বীপকে সংস্কৃত চর্চার অক্সফোর্ড বলা হত। এতো এতো পণ্ডিত ছিলেন সেখানে। বিদ্যাসাগরের একটি সংস্কৃত ছাপাখানা ছিল। এই ছাপাখানা নিয়ে তাঁর ভাই শম্ভুচন্দ্র ন্যায়রত্নের সাথে এক সময় মামলা হয়। বিদ্যাসাগর এতে জয়ীও হন। এরপরও ভাইয়ের স্ত্রীর কাছ মাসোহারা পাঠাতেন। যাক এটা তাঁর পারিবারিক বিষয়।
ব্যাকরণে বাংলা অনুবাদ চালু করায় ব্রাহ্মণ অব্রাহ্মণ নির্বিশেষে স্কুলস্তরে কলেজস্তরে সংস্কৃত চর্চার সুযোগ আসে, বাংলা গদ্যের জনক নিয়ে একটা বিভ্রান্তি আছে। কেউ বলেন বাংলা গদ্যের জনক রাজা রামমোহন কেউ বলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। এগুলো সঠিক নয়। বাংলা গদ্যের বিকাশ ও ক্রম বিকাশের ক্ষেত্রে কোন একজন ব্যক্তি বিশেষের অবদান নয়। শ্রীরামপুর মিশনারী প্রেসের যারা খৃষ্টধর্ম প্রচারক ছিলেন তারাও ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বিশেষ করে এই উইলিয়াম কেরীর নেতৃত্বে বাংলা গদ্যচর্চার একটা সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা হয় এবং বাইবেলকে বাংলায় অনুবাদ করা হয়। এছাড়াও আমাদের শাস্ত্রীয় গ্রন্থগুলো অনুবাদ করা হয় । কাজেই বাংলা গদ্যের ক্রমবিকাশের ইতিহাসে মিশনারী প্রচারকদের ভূমিকা, রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগেরর ভূমিকা এই সব কিছু মিলেই। কোন একক ব্যক্তির কৃতিত্ব নয়। ডা. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত বইটিতে এর উল্লেখ মিলে।
বিদ্যাসাগর সর্বপ্রথম মধ্যযুগের বিভিন্ন পাণ্ডুলিপির মধ্যে হাতে লেখা তালপুঁথির মধ্যে যে বাংলা হরফগুলো ছিল এগুলোর কোণ বের করে মাত্রা দিয়ে তিনি সুন্দর এক একটা চেহেরা দেন। এই অক্ষরগুলোকে আজও বিদ্যাসাগর হরফ বলা হয়। হরফের এই চেহারাটা বিদ্যাসাগর স্থির করে দিয়েছেন। বহু পরে পঞ্চানন কর্মকার বিদ্যাসাগরের হাতের লেখাকে মডেলিং করে সিসা ঢালাই করে অক্ষর তৈরী করেন।
প্রাচীন বাংলা গদ্যে বা পদ্যে কোন যতি চিহ্ন ছিল না। শুধু দাড়ি আর জোড় দাড়িই ছিল। ঈশ্বরচন্দ্র ও মাইকেল মধুসূদন দত্তের যৌথ অবদানের কারণে বাংলাভাষাতে এই দাড়ি, কমা, সেমিকলন, ড্যাস, হাইফেন কিছু বিদেশী যতি চিহ্নের প্রচলন ঘটেছে। বাংলাভাষা স্কুলের ছেলে-মেয়েদের পড়তে গেলে তার যে সিলেবাস বা পাঠ্যক্রম সেটার সুনির্দিষ্ট রূপ দেন বিদ্যাসাগর। ১২টা স্বরবর্ণকে তিনি পৃথক করেছেন চারটা সিরিজ দিয়ে। আর ব্যাঞ্জনবর্ণগুলোকে করেছেন পাঁচটা পাঁচটা করে সিরিজ দিয়ে। স্বরবর্ণের বিন্যাস এবং ব্যাঞ্জনবর্ণের বিন্যাসে এবং আশ্রয়বাদী বর্ণ যেগুলো রয়েছে যাদের নিজের কোন অবস্থান নেই, অন্যবর্ণের আগে বা পরে বসে বর্ণকে অর্থবহ করে। যেমন অনুস্বার (ং) বিসর্গ (ঃ), চন্দ্রবিন্দু ( ঁ) -- এগুলোকে তিনি ব্যাঞ্জনবর্ণের সবশেষে স্থান দিয়েছেন।
এই শৃঙ্খলাটা একেবারে রবীন্দ্রনাথের শৈশবের যুগ থেকে এখনকার প্রজন্ম পর্যন্ত অনুসরণ করছে। এটা বিদ্যাসাগরের কৃতিত্ব। আর বাঙালির উচ্চারণে আসে এই বর্ণগুলোকে বিদ্যাসাগর যখন শৃঙ্খলাবদ্ধ করছেন তখন তিনি দেখেন বাঙালির উচ্চারণে দীর্ঘ ঋৃ নেই দীর্ঘ ৯ নেই। এই দু’টোকে তিনি তখন বর্জন করেন। এই যুক্তিতে হ্রস্ব ৯ কেও বর্জন করার কথা ছিল কারণ হ্রস্ব ৯ র ব্যবহার বাঙালির নেই। কিন্তু কোমলমতি শিশুদের চারটা চারটা স্বরবর্ণের সিরিজ মিলাতে গিয়ে হ্রস্ব ৯ টা রেখে দেন। যদিও সংস্কৃতে এই দু’টো বর্ণই রয়েছে। আগে সংস্কৃতভাষায় মানুষ শিক্ষালাভ করতেন। কারণ আগে তো বাংলাভাষায় কোনো সিলেবাস বা পাঠ্যক্রম ছিল না। তাই সংস্কৃতভাষায় য়, ড়, ঢ় বর্ণগুলো নেই। (আষাঢ়, বাড়ি, নিয়ম)। কিন্তু বাঙালি উচ্চারণে এগুলি আছে বলে তিনটা অক্ষর তিনি আমাদের জন্য সৃষ্টি করে দিলেন। এটা বিশাল অবদান তাঁর। প্রথম তিনি আমাদের অক্ষর শেখালেন, প্রতিটি অক্ষরকে ডবল করে একটা করে শব্দ শেখালেন। শব্দকে যুক্ত করে বাক্য শেখালেন। আমাদের জন্য তিনি গল্প রচনা করলেন। যেমন “গোপাল অতি সুবোধ বালক” ইত্যাদি গল্পগুলি।
আমাদের বাঙালিদের মধ্যে অষ্টাদশ থেকে উনবিংশ শতাব্দিতে যে নবজাগরণ হয়েছে এই নবজাগরণের বড় বড় মণীষীরা প্রত্যেকটা ক্ষেত্রকে ১০০ বছর এগিয়ে দিয়ে গেছেন। তাঁরা সকলেই প্রণম্য। কিন্তু বিদ্যাসাগরকে আমরা কেন প্রাতঃস্মরণীয় বলি ! বলি একারণে যে প্রাতঃকালে শয্যাত্যাগ করেই আমাদের শিশুরা যে ভাষায় পড়ে, যে বর্ণ পরিচয় তারা নেয়, -- এ থেকে প্রথমেই বিদ্যাসাগরের কাছে তাদের ঋণ দিয়ে দিন শুরু হয়, সকালবেলা বিদ্যাসাগরকে স্মরণ করা ছাড়া আমাদের উপায় নেই বলেই তিনি প্রাতঃস্মরণীয়। কাজেই বাংলা ভাষা বাংলা লিপি, বাংলা বর্ণ, বাংলা অক্ষর যতদিন থাকবে ততদিন বিদ্যাসাগরের অবদান থাকবে। এর মানে এই নয় যে বিদ্যাসাগরের আগে আমাদের বাংলা বর্ণ ছিল না অক্ষর ছিল না। আমাদের চর্যাপদের যে কবিতাগুলি রয়েছে তখনও তো বাংলা হরফ ছিল। কিন্তু সেগুলোর সুদৃশ আকার ছিল না বা বড়– চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের যে পাণ্ডুলিপি তাতে গোল গোল অক্ষর একসাথে ঠেসে লেখা। শব্দের মাঝে কোন ফাঁক নেই । এগুলোকে শৃঙ্খলাবদ্ধ রূপ বা সংস্কার সাধন করেছিলেন তিনি। এই সংস্কারের পর এখন পর্যন্ত আর বাংলা অক্ষরের মধ্যে আর কোনো সংস্কার সাধিত হয়নি। দু’শো বছরের মধ্যে বিদ্যাসাগরের অবদান কতটুকু স্মরণীয় এখানেই তা অনুমেয়। রবীন্দ্রনাথের মতো মানুষও বিদ্যাসাগরের বই শৈশবে পড়েছেন “জল পড়িতেছে, পাতা নড়িতেছে”। এক সময় বিশ্ববরেণ্য কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই বলেছেন -
“বিদ্যাসাগরের চরিত্র বাঙালির জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠিত হইয়া থাকিবে।'
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন